শিক্ষক জ্ঞান ও চরিত্রের প্রহরী

অনলাইন ডেস্ক

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কোনো জাতি নেই যারা জ্ঞানের মূল্য অস্বীকার করেছে, আর এমন কোনো সভ্যতা নেই যা শিক্ষকের হাত ধরে বিকশিত হয়নি। কারণ শিক্ষক আলোর বাহক, আত্মার স্থপতি এবং মানবতার দিকনির্দেশক। শিক্ষক হচ্ছেন সেই প্রজ্বলিত মশাল, যার আলোয় জাতি এগিয়ে চলে অজ্ঞতার অন্ধকার ভেদ করে। আধুনিক বিশ্বে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর এই আলোর বাহকদের অবদান স্মরণে পালিত হয় “বিশ্ব শিক্ষক দিবস”।
অথচ চৌদ্দ শতাব্দী পূর্বেই ইসলাম শিক্ষক ও জ্ঞানদাতাকে এমন সম্মান দিয়েছে, যা আজও মানবতার জন্য চিরন্তন দিশারি।
পবিত্র কোরআনের প্রথম ওহি-

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ১)

এই আয়াতে জ্ঞানের সূচনা হয়েছে “পড়” নির্দেশ দিয়ে, যা শিক্ষক ও শিক্ষার সম্পর্কের মূল ভিত্তি। পবিত্র কোরআন নিজেই জ্ঞান ও শিক্ষার সর্বোচ্চ মর্যাদা ঘোষণা করেছে—

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ

‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা বহু স্তর উন্নীত করবেন।

’ —(সূরা আল-মুজাদিলা, আয়াত : ১১)
অর্থাৎ, আল্লাহ নিজেই জ্ঞানী ও শিক্ষাদাতার মর্যাদাকে মানবসমাজে উন্নীত করে দিয়েছেন। যে শিক্ষক অন্যকে জ্ঞানের আলো দেন, তিনি আসলে আল্লাহর নির্দেশের ধারক ও বাহক।

মহানবী (সা.) ছিলেন আদর্শ শিক্ষক

মহানবী (সা.) ছিলেন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি বলেছেন—

إِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا

‘আমাকে তো কেবল একজন শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।

’ (মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭) এই সংক্ষিপ্ত বাণীতেই নিহিত রয়েছে শিক্ষকতার পূর্ণ মাহাত্ম্য। মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই শেখাননি, বরং নৈতিকতা, নেতৃত্ব, আচরণ এবং মানবিকতা শেখিয়েছেন। তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার পাঠশালা।
তিনি বলেছেন—

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ

‘তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে শিখে ও অন্যকে শেখায়।’ (বুখারি, হাদিস: ৫০২৭) এই হাদিস দ্বারা মহানবী (সা.) শিক্ষকদের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের কাতারে স্থান দিয়েছেন।

কারণ, শিক্ষক কেবল একজনকে নয়, প্রজন্মকে গড়ে তোলেন।
শিক্ষকগণ নবুয়তের উত্তরাধিকারী

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষকের কাজ নবীদের কাজেরই ধারাবাহিকতা। মহানবী (সা.) বলেন-

وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ، كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا، وَلَا دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ

‘আবেদ (সাধারণ ইবাদাতকারী) ব্যক্তির উপর ’আলিমের ফজিলত হলো সমস্ত তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদার মতো। জ্ঞানীরা হলেন নবীদের উত্তরসুরি। নবীগণ কোনো দীনার বা দিরহাম মীরাসরূপে রেখে যান না; তারা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে।’ —(সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৩৬৪১)

এখানে “আলেম” বলতে শুধু ধর্মীয় পণ্ডিত নয়, বরং সকল সত্যনিষ্ঠ শিক্ষকই অন্তর্ভুক্ত। তারা জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করেন, ন্যায়-অন্যায় চেনান, আর আল্লাহর পথের দিশা দেন। তাই শিক্ষককে অসম্মান করা মানে নবুয়তের উত্তরাধিকারকেই অসম্মান করা।

সাহাবা ও তাবেঈনদের দৃষ্টিতে শিক্ষক

আলী (রা.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি আমাকে একটি অক্ষরও শিখিয়েছে, আমি তার দাস হয়ে গেছি।’ —( জামি বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাজলিহি, ইবনে আবদুল বার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯৭) এই উক্তিতে স্পষ্ট, ইসলামী সভ্যতায় শিক্ষককে কেবল জ্ঞানদাতা নয়, বরং আধ্যাত্মিক অভিভাবক হিসেবে দেখা হতো।

ইমাম নববী (রহ.) তাঁর الأدب في طلب العلم এ বলেছেন—

من قل أدبه مع معلمه حرم بركة العلم.

(“যে তার শিক্ষকের সঙ্গে শিষ্টাচারহীন আচরণ করে, সে জ্ঞানের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।”) এ কারণেই প্রাচীন মুসলিম সমাজে শিক্ষককে সর্বোচ্চ মর্যাদায় রাখা হতো, এমনকি শাসকরাও তাঁদের সামনে বিনয়ী হতেন।

শিক্ষকের প্রতি শিষ্যের দায়িত্ব

ইসলাম শিক্ষার্থীর প্রতি নির্দেশ দেয়—

وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا

‘হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’ —(সূরা ত্বা-হা: ১১৪)

জ্ঞান বৃদ্ধির এই প্রার্থনা তখনই পূর্ণ হয়, যখন শিক্ষার্থী শিক্ষককে শ্রদ্ধা ও অনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণ করে। ইমাম মালেক (রহ.) তাঁর শিষ্য ইমাম শাফেয়ীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন,

يا بني، إن العلمَ آدابٌ ستة: أولها التواضع، والثانية الاستماع، والثالثة الحفظ، والرابعة العمل، والخامسة النشر، والسادسة التبليغ.

‘হে পুত্র! জ্ঞান অর্জনের ছয়টি ধাপ রয়েছে- প্রথম ধাপ বিনয়, দ্বিতীয় ধাপ শ্রবণ, তৃতীয় ধাপ মুখস্থ করা, চতুর্থ ধাপ আমল করা, পঞ্চম ধাপ প্রচার করা, এবং ষষ্ঠ ধাপ তা পৌঁছে দেওয়া।” (উয়ুনুল আখবা লি ইবনু কুতাইবা, খণ্ড ২, পৃ. ১২৯)

আলোচনার ধারাবাহিকতায় এটা নির্বিঘ্নে বলা যায় যে, শিক্ষককে অবজ্ঞা করলে জ্ঞানের দরজা কখনোই উন্মুক্ত হয় না।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষকের গুরুত্ব

আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল শিক্ষার যুগেও শিক্ষক অপরিহার্য। কারণ, তথ্য দিতে পারে মেশিন, কিন্তু হৃদয়ে চরিত্র, বিবেক ও মূল্যবোধ জাগাতে পারে কেবল শিক্ষক। পশ্চিমা সভ্যতা যেখানে শিক্ষাকে পেশা হিসেবে দেখে, ইসলাম সেখানে এটিকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করে। কারণ, শিক্ষক তার জ্ঞান দ্বারা সমাজকে সংশোধন করেন এবং আল্লাহর সৃষ্টি জগতকে চিনতে শেখান।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস কেবল আনুষ্ঠানিক স্মরণ নয়, বরং শিক্ষকতার প্রতি চিরন্তন কৃতজ্ঞতার দিন। ইসলাম শিক্ষককে সম্মান দিয়েছে পিতা-মাতার পরেই; কারণ, তিনি আত্মার জন্মদাতা। মহানবী (সা.) এর একটি হাদীসের ভাষ্য অনেকটা এ রকম যে,

‘তিনজনের অধিক হক কেউ রাখে না: তোমার জনক, তোমার মাতা, এবং তোমার শিক্ষক।’ (জামউ বায়ানিলি ইলমি ওয়া ফাজলিহি লি ইবনে আবদিল বার, খণ্ড ১, পৃ. ৯৭–৯৮)

যে সমাজ শিক্ষককে সম্মান করে, সেই সমাজ জ্ঞানে-আচরণে ও নৈতিকতায় উন্নত হয়। আর যে সমাজ শিক্ষককে অবমূল্যায়ন করে, সে সমাজ আলোকচ্যুত হয়ে ধ্বংসের পথে যায়।

তাই আমাদের উচিত; শিক্ষককে ভালোবাসা, সম্মান করা, তাঁদের কাছে দোয়া চাওয়া, এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। কেননা, তারা হলেন মানবতার আলোকবর্তিকা, নবুয়তের উত্তরাধিকারী, ও জাতির সত্যিকারের নির্মাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *