মুফতি সাইফুল ইসলাম
মানব সভ্যতা যতই উন্নত হোক না কেন, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ছায়া আজও সমাজ থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। ইসলাম আগমনের পূর্বে আরব সমাজ ছিল চরম জাহেলিয়াতের আঁধারে নিমজ্জিত—বংশের অহংকার, কুসংস্কার, মৃতের জন্য অতিরিক্ত বিলাপ, এমনকি প্রকৃতির উপাদানকে দেবতাস্বরূপ বিশ্বাস করাও ছিল তাদের জীবনের অংশ। ইসলামে এসেছে এসব অজ্ঞতার শৃঙ্খল ভেঙে মানুষকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করতে। তবুও মহানবী (সা.) তাঁর দূরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে সতর্ক করেছেন যে এসব জাহেলি প্রথার কিছু কিছু ছায়া তাঁর উম্মতের মধ্যেও টিকে থাকবে।
আবু মালিক আল আশ’আর (রা.) থেকে বর্ণিত-
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” أَرْبَعٌ فِي أُمَّتِي مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِي الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِي الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ وَالنِّيَاحَةُ ” . وَقَالَ ” النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ ” .
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার উন্মতের মধ্যে জাহেলী যুগের চারটি কু-প্রথা রয়ে গেছে, যা লোকেরা পরিত্যাগ করতে চাইবে না। (১) বংশের গৌরব, (২) অন্যকে বংশের খোঁটা দেয়া, (৩) নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা, (৪) মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা। তিনি আরো বলেন, বিলাপকারী যদি মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে এভাবে উঠানো হবে যে, তার গায়ে আলকাতরার (চাদর) খসখসে চামড়ার ওড়না থাকবে। (মুসলিম, হাদিস : ৯৩৪)
হাদিসের ব্যাখ্যা
‘জাহেলি যুগ’ বলতে বোঝায় ইসলাম আগমনের পূর্ববর্তী সেই সময়কে, যখন মানুষ অন্ধবিশ্বাস, অহংকার, বংশগৌরব ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল।
ইসলামের আলো আসার পরও রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছিলেন যে, এই চারটি অন্ধ প্রথা সহজে নির্মূল হবে না।
১. বংশের গৌরব করা — অহংকারের প্রথম ধাপ
বংশ বা জাতির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্ব করা জাহেলি মানসিকতার অন্যতম লক্ষণ। আরবরা একে অপরকে বলত : ‘আমি অমুক গোত্রের, আমার রক্ত বিশুদ্ধ।’ কিন্তু ইসলাম এ ধরনের অহংকারের শিকড়ই ছেঁটে দিয়েছে।
বংশের গৌরবে গর্ব করা মানে মানবতার পরিবর্তে রক্তের অহংকারকে গুরুত্ব দেওয়া। আজও সমাজে এই রোগ বিদ্যমান—জাতি, গোত্র, পেশা কিংবা সামাজিক মর্যাদা নিয়ে গর্ব। অথচ আল্লাহ বলেন— ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাবান সে-ই, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
২. অন্যের বংশের নিন্দা — সামাজিক বিভেদ ও ঘৃণার বীজ
যেমন নিজের বংশ নিয়ে গর্ব করা পাপ, তেমনি অন্যের বংশের নিন্দা করা আরও ঘৃণিত। কারণ এতে সৃষ্টি হয় শ্রেণিবৈষম্য ও সামাজিক বিদ্বেষ।
ইসলাম শিখিয়েছে, “কোনো জাতি অপর জাতিকে উপহাস করো না; হতে পারে, তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম।”
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত: ১১)
আজকের সমাজে আমরা তা দেখতে পাই—জাতি, গোত্র, অর্থনৈতিক স্তর বা রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে অন্যকে হেয় করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে বলেন—
الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
“মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০) অতএব, অন্যের বংশ বা পরিচয়কে খাটো করা মানে আল্লাহর সৃষ্ট বৈচিত্র্যকে উপহাস করা, যা ঈমানের পরিপন্থী।
৩. নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি প্রার্থনা — কুসংস্কার ও শিরকের ছায়া
জাহিলী যুগে আরবরা বিশ্বাস করত, নির্দিষ্ট নক্ষত্রের উদয় বা অস্তের ফলে বৃষ্টি হয়। কিন্তু ইসলাম এই বিশ্বাসকে শিরক (আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন) হিসেবে ঘোষণা করে। আসলে, নক্ষত্র বা কোনো প্রাকৃতিক উপাদান আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কিছুই ঘটাতে পারে না। কোরআনে বলা হয়েছে— ‘আল্লাহই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন; তিনিই জীবিত করেন মৃত পৃথিবীকে।’ (সুরা : রূম, আয়াত : ২৪)
আধুনিককালে এই কুসংস্কার শুধু জ্যোতিষশাস্ত্রে সীমাবদ্ধ নয়; বরং অনেকে ভাগ্য নির্ধারণ, তারকা-ফল বা রাশিফলে বিশ্বাস রাখে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে একইরূপ বিভ্রান্তি।
৪. মৃতের জন্য বিলাপ — নিয়তির প্রতি অসন্তোষ
মৃতের জন্য শোক প্রকাশ মানবিক, কিন্তু বিলাপ বা অতিরিক্ত আর্তনাদ ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এটি আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশের শামিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘যে মৃতের জন্য মুখে চপেটাঘাত করে, জামা ছিঁড়ে আর জাহেলি যুগের আহাজারি করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৯৪)
এই হাদিসে উল্লিখিত শাস্তির চিত্র—‘আলকাতরার পোশাক ও খসখসে চামড়ার ওড়না’—একটি প্রতীকী বর্ণনা, যা বিলাপকারিণীর আত্মিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। আলকাতরা যেমন দাহ্য ও দুর্গন্ধযুক্ত, তেমনি এ ধরনের কাজ আত্মাকে কলুষিত করে তোলে।
এই চারটি কু-প্রথা শুধু ইতিহাসের অংশ নয়—আজও মুসলিম সমাজের ভেতর নানা রূপে বিদ্যমান।
যেমন—
পারিবারিক গৌরব নিয়ে অহংকার,
সামাজিক শ্রেণিবিভাজন,
ভাগ্য ও রাশিফলে বিশ্বাস,
মৃতের জন্য প্রকাশ্য বিলাপ ও শোকানুষ্ঠান।
এই সব কিছুর মূলেই রয়েছে ঈমানের দুর্বলতা ও আল্লাহর তাওহিদের প্রতি অবহেলা। নবী করিম (সা.) এই হাদিসের মাধ্যমে তাঁর উম্মতকে এক চিরন্তন সতর্কবার্তা দিয়েছেন। যে সমাজে বংশের গর্ব, কুসংস্কার, শিরক ও নিয়তির প্রতি অসন্তোষ পুনর্জীবিত হয়, সে সমাজে জাহিলীয়াত আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
অতএব, ঈমানদার সমাজের কর্তব্য হলো হৃদয়ে ও আচরণে তাওহিদের দৃঢ়তা স্থাপন করা— “যাতে মানুষ বুঝে নেয়, ‘মর্যাদা রক্তে নয়, তাকওয়ায়; নিয়ন্ত্রণ নক্ষত্রে নয়, আল্লাহর ইচ্ছায়।’”
















Leave a Reply