অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এবং দেশের বৃহত্তম খেজুর গুড়ের হাট চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বর্তমানে ভেজাল গুড়ের দৌরাত্ম্য এবং খেজুরগাছের তীব্র সংকটের মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। খুলনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি যৌথ গবেষণায় এই ঐতিহ্যবাহী হাটের টেকসই ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ে প্রকাশিত এই গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মো. নুরুল আলম এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. আল-আমিন।
গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানীয়ভাবে হাটটি ৩০০ বছরের পুরনো বলে দাবি করা হলেও এর প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় প্রায় ১০০ বছর আগে, ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে।
গবেষক দলের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ আলম বলেন, “সরোজগঞ্জ হাট বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যা গত প্রায় ১০০ বছরে একটি মিশ্র অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে হাটটি ৩০০ বছরের পুরনো বলে দাবি করা হলেও, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে ‘সরোজগঞ্জ’ নামকরণের পরই মূলত এই গুড়ের হাটটির যাত্রা শুরু হয়।
‘তবে আমাদের গবেষণায় এর স্থায়িত্ব নিয়ে গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জও উঠে এসেছে’ উল্লেখ করে ড. আলম বলেন— “আমরা দেখছি, খেজুরগাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যার একটি বড় কারণ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে এর ব্যবহার। সেই সঙ্গে খেজুরের রস সংগ্রহের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় (গাছি) নতুন প্রজন্মের আগ্রহও কম।
কিন্তু সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ভেজাল গুড়ের দৌরাত্ম্য। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত লাভের আশায় গুড়ের সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক, সোডা, রং ও ফিটকিরি মেশাচ্ছে, যা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সুনাম নষ্ট করছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। এই সমস্যাগুলো এখনই সমাধান না করা হলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র ঝুঁকির মুখে পড়বে।’
গবেষকরা বলছেন, এই তীব্র চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সরোজগঞ্জ হাট এখনো গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বিশাল চালিকাশক্তি হিসেবে টিকে আছে।
গবেষণায় হাটটিকে একটি মিশ্র কেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেখানে বাণিজ্য, আর্থিক এবং শিল্প—এই তিনটি খাতের বৈশিষ্ট্য একীভূত হয়েছে।
বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এর গুরুত্ব তুলে ধরে গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এই হাট থেকে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা গুড় সংগ্রহ করেন। শুধু দেশেই নয়, এখান থেকে সংগৃহীত গুড় ভারত, সুইডেন, কানাডা, ইতালি, সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
এই বাণিজ্যের আর্থিক আকারও বিশাল। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-২০২২ সালের মধ্যে প্রতি মৌসুমে গড়ে ৫,৪১২ মেট্রিক টন গুড় লেনদেন হয়েছে, যার গড় আর্থিক মূল্য প্রায় ৭০৩ মিলিয়ন বাংলাদেশি টাকা।
গবেষকরা জানান, এখানে প্রধানত চার ধরনের গুড় বিক্রি হয়—পাটালি (নোলেন পাটালি), দানা গুড়, ঝোলা গুড় এবং চিটিয়া গুড়।
অর্থনৈতিক এই কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে একটি গ্রামীণ উদ্যান পালনভিত্তিক শিল্পও গড়ে উঠেছে। গবেষকরা আরো জানান, এই গুড়শিল্পকে সমর্থন দিতে- অর্থাৎ গুড় সংরক্ষণ ও বাজারজাত করার পাত্র সরবরাহের জন্য একটি সহযোগী মৃৎশিল্পও বিকশিত হয়েছে।













Leave a Reply