অনলাইন ডেস্ক
কুড়িগ্রামের সীমান্ত এলাকা নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন কুড়িগ্রাম-১। এই আসনটি বেশিরভাগ সীমান্তবর্তী ও নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনের প্রার্থীরা সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মাদক ও চোরাচালান বন্ধ, এলাকার উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনসংযোগ, মিছিল, মিটিং ও মতবিনিময় সভা করছেন। আসনটি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির (জাপা) দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এবার সেই দুর্গে হানা দিতে চায় বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা।
আসনটিতে বেশ কয়েকজন প্রার্থী প্রচারণায় নেমেছেন এবং ভোটারদের কাছে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তারা হলেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইফুর রহমান রানা,বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আলহাজ হারিছুল বারী রনি, জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) মাহফুজুল ইসলাম কিরন ও জাকের পার্টি থেকে আব্দুল হাই মাস্টার নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিশ্রতি।
দলীয় প্রতীক কিংবা নেতা নয়, প্রয়োজন বাস্তব উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম—এমন একজন প্রতিনিধি, যিনি দুর্যোগে-দুর্দিনে মানুষের পাশে থাকবেন।
তবে জাপার সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেলে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। অন্যদিকে, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন জোটবদ্ধ হলে আসনটি তাদের দখলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য আসন উদ্ধারে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
স্বাধীনতার পর এ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও তৃতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দশম সংসদ পর্যন্ত (ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের নির্বাচন ছাড়া) ছিল জাপার দখলে। আগামী নির্বাচনে আসনটি দখলে নিতে মরিয়া বিএনপি। তবে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে ইসলামি দলগুলোর জোটবদ্ধ হওয়া।
ভোটাররা জানান, দলীয় প্রতীক কিংবা নেতা নয়, তাদের প্রয়োজন বাস্তব উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম এমন একজন প্রতিনিধি, যিনি দুর্যোগে-দুর্দিনে মানুষের পাশে থাকবেন।
বিএনপিকে ভোট দিতে মানুষ অতি আগ্রহে বসে আছে। আমরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করবো। এমপি হলে চোরাচালান রোধসহ এলাকার উন্নয়ন করবো।
সাইফুর রহমান রানা, বিএনপি মনোনীত প্রার্থী
বিএনপির প্রার্থী সাইফুর রহমান রানা নাগেশ্বরী উপজেলার কলেজ মোড় এলাকায় ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মৃত মনছুর আলী ও সালেহা দম্পতির সন্তান। তিনি একটি বেসরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৭৯ সালে ছাত্রদলের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। ২০০৩ সালে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও সংসদ ভেঙে যাওয়ায় তিন মাস পর্যন্ত এমপি ছিলেন সাইফুর রহমান রানা। ২০০১ সালের অষ্টম, ২০০৮ সালের নবম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনয়ন নিয়ে অংশ নিয়ে পরাজিত হন।
সাইফুর রহমান রানা বলেন, বিএনপিকে ভোট দিতে মানুষ অতি আগ্রহে বসে আছে। আমরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করবো। এমপি হলে চোরাচালান রোধসহ এলাকার উন্নয়ন করবো।
নির্বাচিত হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ অনুযায়ী ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বৈষম্যহীন একটি সমাজ কায়েম, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধান করবো।
অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সিট পাইকারছড়া গ্রামে মুসলিম পরিবারে ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ওই এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মমতাজ উদ্দিন মন্ডল ও আনোয়ারা বেগমের সন্তান। ১৯৯২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে এমএসএস ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৯৫ সালে রংপুর মডেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে সহকারী অধ্যাপক ও অর্থনীতি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
ছাত্র জীবনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির কারমাইকেল কলেজ শাখার সভাপতি হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম। বর্তমানে রংপুর মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় ইউনিট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এমপি নির্বাচিত হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ অনুযায়ী ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বৈষম্যহীন একটি সমাজ কায়েম, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধান করবো।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আলহাজ হারিছুল বারী রনি নাগেশ্বরী উপজেলার আদর্শ পাড়া গ্রামে ১৭ নভেম্বর ১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আজাদ আলী ও হাসিনা বেগম দম্পতির সন্তান। বাবা পেশায় একজন কৃষক। তিনি ২০০০ সালে নাগেশ্বরী ডিগ্রি মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন। এরপর ব্যবসা ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে যোগ দেন। বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাগেশ্বরী উপজেলা সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আলহাজ হারিছুল বারী রনি বলেন, এ আসনে কিছু এলাকায় নদী ভাঙন রোধ, রাস্তাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন এবং মাদক নির্মূলে কাজ করবো।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মনোনীত প্রার্থী মাহফুজুল ইসলাম কিরন ভূরুঙ্গামারী উপজেলার কামাত আঙ্গারীয়া গ্রামের আজিজুর রহমান ও মাসসুদা রহমানের সন্তান। তার জন্ম ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে। তিনি ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি (ফলিত পরিসংখ্যান) বিভাগ থেকে পাশ করেন। তিনি উপজেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী ও জেলা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মাহফুজুল ইসলাম কিরন বলেন, এলাকায় সড়ক, ব্রিজ, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট উন্নয়ন, সীমান্ত নিরাপত্তাকে প্রথম অগ্রাধিকার। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সার, বীজ, সেচ ও বাজার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনসহ সব সুবিধা দেওয়া হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দুর্যোগ নিরাপত্তায় আধুনিক সেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে যুবকদের জন্য স্কিল ট্রেনিং ও ক্ষুদ্র ব্যবসা সহায়তা চালু করা চরাঞ্চলের নদী ভাঙন রোধ, বাঁধ মেরামত ও নৌ-সড়ক যোগাযোগ উন্নত করে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, নিশ্চিত সুশাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের সমস্যায় দ্রুত সমাধান করবো।
জাতীয় পার্টির পেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক এমপি এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৬১ সালে ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দেওয়ানের খামার এলাকার আহমদ আলী সরকার ও নুর হোসনে আরা বেগমের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এইচএসসি পাশ করে ব্যবসা ও রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। চতুর্থবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির পেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কুড়িগ্রাম-১ আসনের সাবেক এমপি এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দলটি নির্বাচনে অংশ নিলে আমি মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হবো।
জাকের পার্টির প্রার্থী আব্দুল হাই মাস্টার। তিনি ১৯৬২ সালে বঙ্গসোনাহাট এলাকার এন্তাজ আলী ও আলীমন নেছা দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০২২ সালের অক্টোবরে চর ভূরুঙ্গামারী উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। এর মধ্যে তিনি একবার ২০০৩ সালে বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ২০০৯ সালে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগেও তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাকের পার্টি থেকে অংশ নিয়েছেন।
আব্দুল হাই মাস্টার বলেন, আমি নির্বাচিত হলে নারীর উন্নয়ন, গ্যাস লাইন সম্প্রসারণ, কলকারখানা স্থাপন, কচাকাটা থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, গরিব মানুষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদান, চরাঞ্চলের মানুষের জন্য চাইনিজ পদ্ধতিতে নদী শাসন ব্যবস্থার প্রচলন এবং চরাঞ্চলে গবাদিপশু পালনের মাধ্যমে মাংস ও দুধ রপ্তানি করবো।
কুড়িগ্রাম-১ আসন ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। মোট ভোটার ৫ লাখ ২৯ হাজার ১৬৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৩ জন, নারী ভোটার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার তিনজন। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও আসনটি উদ্ধারে মরিয়া বিএনপি।













Leave a Reply