একাত্তরের ২৮ মার্চ: ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে নিহত হয় হাজারো মানুষ

সাইফুল ইসলাম মুকুল :

আজ ২৮ মার্চ, রংপুরের মানুষের জন্য স্মরণীয় ও বীরত্বগাঁথার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দিনে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে এক অনন্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল অকুতোভয় বীর বাঙালি।

যথাযথ মর্যাদায় রংপুরের ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস পালন করা হবে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পার হলেও এখনো জাতীয়ভাবে দিনটির স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার নজির বিশ্বে আর কোনো দেশে নেই। এটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাহসিকতার এক বিরল ঘটনা।

প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা জানান, একাত্তরের শুরুতে ৩ মার্চ শহীদ হন কিশোর শংকু সমজদার। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে ওঠে আসে রংপুরের নাম। সেই ভাষণের পর রংপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এরই মধ্যে ২৪ মার্চ নিসবেতগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আব্বাসী নামের এক সেনাসদস্যকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় শাহেদ আলী নামের একজন মাংস বিক্রেতা। এ নিয়ে গোটা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্রোধে ফেটে পড়ে। রংপুরের স্বাধীনতাকামী মানুষও ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের জন্য বিভিন্ন হাট-বাজার, এলাকায় ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় দিনক্ষণ। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রচারে মেলে অভূতপূর্ব সাড়া।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রোববার ছিল। সেদিন সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। রংপুর সদর, গংগাচড়া, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র, কৃষক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব পেশার মানুষ দা, কোদাল, কুড়াল, বর্শা, বল্লম হাতে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় একত্রিত হন। বিশেষ করে আদিবাসী সাঁওতালরা তীর-ধনুক হাতে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে আসেন। বেলা ১১টার দিকে হাজার হাজার মানুষ ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়ে। এতে মাত্র ৫ মিনিটে এলাকাটি স্তব্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার মরদেহ পড়ে থাকে মাঠে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরদেহগুলো একখানে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তখনও যেসব মানুষ বেঁচে ছিলেন তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সে সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সে দিনের বর্ণনায় এসব তথ্য তুলে ধরেছেন।

তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ-বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশমতো ৫ থেকে ৬শ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। এ আগুন অন্য যে কোনো আগুনের চেয়ে অনেক বেশি লাল। অনেক বেশি দহন করে এই বহ্নিশিখা। খুব কাছ থেকেই সেই আগুন আমি দেখছি। দেখছি কেমন করে জ্বলছে স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানব সন্তান।’

সেদিনের ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমান বলেন, মুক্তির নেশায় পাগল এসব মানুষদের সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন এমপি, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান, মুখতার এলাহি, আবুল মনছুর, ইছহাক চৌধুরী, ন্যাপ নেতা সামছুজ্জামান ও কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরও অনেকে। সেদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম ও বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীরে জমায়েত হয়। শুরু হয় পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াই।

তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায়ের তীরন্দাজ সাঁওতালরা এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে বৃষ্টির মতো গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই শহীদ হন হাজারেরও বেশি মানুষ। সেদিন এই সম্মুখযুদ্ধে নাম জানা, অজানা অনেক নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। আহত হন অগণিত। এখন এসব শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের খোঁজ রাখে না কেউ। অনেক আহত ব্যক্তি পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে প্রতিবছর রংপুর জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। এদিনে নিসবেতগঞ্জে ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু সেদিনের হাজার হাজার দেশপ্রেমী জনতার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি আজও মিলেনি। প্রতিবছর ২৮ মার্চ এলে কিছু অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে এসব বীর শহীদদের আত্মত্যাগ। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারগুলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *