জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেতা থেকে রিকশাচালক, আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন তিনি

অনলাইন ডেস্ক

হাজার হাজার স্বপ্নবাজ তরুণ প্রতিদিন মুম্বাই শহরে পা রাখেন। সবারই আশা, কোনো পরিচালক বা কাস্টিং এজেন্ট হঠাৎ হয়তো তাঁকে আবিষ্কার করবে, সিনেমায় সুযোগ দেবে; আর জীবনটা পাল্টে যাবে। শফিক সৈয়দ ছিলেন এমনই এক কিশোর—তবে তাঁর গল্পটা অন্য রকম। তিনি সত্যিই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক শিশু, যিনি অভিনয় করেছিলেন মীরা নায়ারের কালজয়ী ছবি ‘সালাম বম্বে!’–তে। ছবিটি তাঁকে এনে দেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ, আন্তর্জাতিক খ্যাতি—কিন্তু এই স্বপ্নের জীবনটি ছিল ক্ষণস্থায়ী।
ছবির সাফল্যের পর দীর্ঘ আট মাস ঘুরেও আর কোনো সিনেমার কাজ জোটেনি। অবশেষে ১৯৯৩ সালে তিনি চিরতরে মুম্বাই ছেড়ে ফিরে যান বেঙ্গালুরুতে। শুরু হয় নতুন জীবন—একজন ভাড়ায় চালানো অটোরিকশাচালক হিসেবে। কোনো এককালে যাঁকে রাষ্ট্রপতি সম্মানিত করেছিলেন, তিনি তখন দিনে মাত্র ১৫০ টাকা আয় করে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাচ্ছেন।

রুপালি পর্দার পেছনে বেঁচে থাকা এক বালকের গল্প
১৯৮০-এর দশকে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপে মুম্বাই চলে আসেন শফিক। ইচ্ছা ছিল সামান্যই, স্রেফ দেখতে চেয়েছিলেন ‘হিন্দি সিনেমায় যা দেখি, তা কি সত্যি?’ তখন তিনি থাকতেন চার্চগেট স্টেশনের পাশের রাস্তায়। এক দিন এক নারী তাঁকে এবং তাঁর মতো আরও কিছু রাস্তার শিশুকে নিয়ে যান একটি অভিনয় কর্মশালায়, ২০ টাকা পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। অন্যরা পালিয়ে গেলেও শফিক থেকে যান।কারণ তিনি ছিলেন ক্ষুধার্ত। সেখানেই এক অডিশনের মাধ্যমে মীরা নায়ার তাঁকে বেছে নেন ‘সালাম বম্বের’ প্রধান চরিত্রে।

ছবিটি একদিকে যেমন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে, তেমনি জায়গা করে নেয় অস্কারের সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়নের তালিকায়—যেটি এখনো পর্যন্ত মাত্র তিনটি ভারতীয় সিনেমা অর্জন করতে পেরেছে।

‘আমি অভিনয় করিনি, জীবন বাঁচিয়েছি’
ওপেন সাময়িকীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শফিক বলেছিলেন, ‘“সালাম বম্বে!”-এর শুটিং চলাকালীন আমি কখনোই মনে করিনি আমি অভিনয় করছি। ছবির ভাষা, গল্প, পরিস্থিতি—সবই আমার জীবনের অংশ ছিল। ওটা ছিল আমার নিজের গল্প। ভারতের রাস্তার জীবন মানেই ছিল এমন এক অবস্থা, যেখানে মৃত্যু ও জীবনের পার্থক্য সামান্যই—আমি সেটিই দেখেছি।’
রঘুবীর যাদব, নানা পাটেকর, অনিতা কানওয়ারের মতো সহশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে শিখেছিলেন—অভিনয় মানে হচ্ছে পরিস্থিতির প্রতি সত্যিকারের প্রতিক্রিয়া দেওয়া।

টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শফিক জানান, ‘আমাকে ১৫ হাজার রুপি দেওয়ার কথা ছিল। শুটিং শেষ হওয়ার পর সেই টাকায় আমি সিনেমা দেখতাম, রাস্তার খাবার খেতাম। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছবি তোলা—সবই স্বপ্নের মতো। কিন্তু এরপর ছবির টিম মুম্বাই ছেড়ে চলে গেল, কেউ আর যোগাযোগ রাখেনি।’

নতুন কোনো কাজ না পেয়ে তিনি নিজের ছবি ও পত্রিকার কাটিং নিয়ে প্রযোজকদের দরজায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অনেক সময় সহকারী পরিচালকরা কাগজে ছবি দেখে জিজ্ঞেস করতেন

গৌতম ঘোষের ছবি ‘পতঙ্গ’-এ শেষবারের মতো অভিনয় করেন। তারপর ১৯৯৩ সালে ফিরে যান বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু তত দিনে তাঁর ভেতরে জমে উঠেছে এক ক্ষোভ, এক হতাশা। তিনি বলেন, ‘“সালাম বম্বে!”কে এখন অনেক সময় দুঃস্বপ্ন মনে হয়। সিনেমা আমাকে কয়েক মিনিটের খ্যাতি দিয়েছিল, তারপর কিছুই না। আমি রুপালি দুনিয়ার ঝলক দেখেছিলাম, তাই আর ফিরে যেতে পারিনি। এই অস্থিরতা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। চেষ্টাও করেছিলাম আত্মহত্যার—একবার চৌপাট্টিতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলাম, আরেকবার বেঙ্গালুরুতে বিষ খেয়েছিলাম। লজ্জা নেই বলতে—বেঁচে থাকা তখন কঠিন হয়ে উঠেছিল।’

পড়াশোনা না থাকায় চিত্রনাট্য পড়তেও পারতেন না, সন্তানদের জন্য একটাই প্রত্যাশা—‘তারা যেন আমার মতো না হয়’। ১৯৯৬ সালে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। তাঁর চার সন্তান—তাদের মধ্যে দুজন স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। ২০১৩ সালে ভারতীয় গণমাধ্যম ডিএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি চাই না আমার সন্তানেরা আমার মতো হোক। যদি আমি পড়াশোনা করতে পারতাম, হয়তো আজ একটা সিনেমার ক্যারিয়ার গড়তে পারতাম। অন্তত চিত্রনাট্য পড়তে পারতাম।’

পরের দিকে অটো চালানো ছেড়ে দেন, ছোটখাটো টেকনিক্যাল কাজ করতে থাকেন কন্নড় টিভি সিরিয়ালে। ‘আর কী করতে পারি বলুন? পরিবার আছে, সংসার চালাতে হয়। জীবনটা ফিরে গেছে সেই জায়গায়, যেখান থেকে শুরু করেছিলা তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখন খুব সাধারণ জীবনযাপন করি। সিনেমা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলি না। মাঝেমধ্যে কোনো ইউনিট যদি বেঙ্গালুরুতে আসে, তাদের সঙ্গে কাজ করি।’
শফিকের জীবনের পরিহাস। ‘সালাম বম্বে!’-এর নির্মাতারাই গড়েছিলেন সালাম বালক ট্রাস্ট, রাস্তার শিশুদের জন্য। কিন্তু সেই শফিক, যিনি তাঁদের সিনেমার নায়ক, সেই ট্রাস্টের ‘যোগ্যতা’ পূরণ করেননি।

যারা ছিল তার পাশে, তাদের কেউ আজ সফল, কেউ বিস্মৃত
ছবিটির সহকারী সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বদীপ চ্যাটার্জি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শফিক ছিল সবচেয়ে বিষণ্ন। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল—এরপর কী হবে? ওকে এনএফডিসিতে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে সে বেঙ্গালুরু চলে যায়। আরেক শিশু অভিনেতা বার্নার্ড ভাগ্যবান ছিল—চিত্রগ্রাহক স্যান্ডি সিসেল তাকে দত্তক নেন, নিয়ে যান লস অ্যাঞ্জেলসে। আজ সে প্রতিষ্ঠিত—একটি মেয়েও আছে।’ স্যান্ডি টাইম সাময়িকীকে বলেন, ‘আমি বার্নার্ডকে অর্থ পাঠাতাম, কিন্তু তার মা সব কিছু বিক্রি করে দিতেন—বই, খেলনা, এমনকি টাকা। তারা এমন এক পরিবেশে বাস করত, যেখানে বাঁচতে হলে মর্যাদা বিসর্জন দিতে হতো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *