ঢাকার দাওয়াতি সাংবাদিকদের দিল্লি কী জানালো?

মোস্তফা কামাল

ভারতের নজরদারিতে আছে বাংলাদেশ। তাও গভীর-নিবিড় নজরদারি। দেশটির রাষ্ট্রীয় ব্যাক্তিরা মাঝেমধ্যেই এ বার্তা দিচ্ছেন। এ অভ্যস্থতায় ঢাকা থেকে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করেও জানানো হলো সামনের নির্বাচনের দিকে তাদের গভীর নজরের কথা। সংখ্যায় তারা ২৩।  এই সাংবাদিকরা  ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ডিক্যাব সদস্য। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে যাতায়াত, ভ্রমণ ও আবাসন সংক্রান্ত খরচাদি ভারত সরকারই বহন করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে নিয়মিত প্রতিক্রিয়া জানানো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকের সাথে তাদের কথা হয়েছে। মতবিনিময় হয়েছে।

বাংলাদেশের ওপর ভারত নিবিড়ভাবে নজর রাখছে, তা নিয়মিত জানিয়েই আসছিলেন জয়শঙ্কর। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের কাছে নিয়ে সেখানে আরেকটু মাত্রা যোগ করলেন বিক্রম মিশ্রি। জানালেন বাংলাদেশে দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ভারত। এ নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সামনেই হয় কথাগুলো। তবে, ঢাকা থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া   জানানো হয়েছে। একে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তার মতে এটি (নির্বাচন) তাদের বিষয় নয়, এটি সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অবশ্য সাংবাদিকদের কেউ বিক্রম মিশ্রির মন্তব্যের উপর পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেছেন বলে তথ্য নেই।

২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেয়া এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ভারতের কোনো শীর্ষ কূটনীতিক এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সাথে খোলামেলা মতবিনিময় করলেন। সেই বিবেচনায় এটি একটি ঘটনা। এ সুযোগে প্রশ্ন করা যেত, জুলাই আন্দোলনের ডকুমেন্টারি কেন ভারতে নিষিদ্ধ? কেন কিছু গণমাধ্যম থেকে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে? সত্যি সত্যি  সম্পর্কের উন্নয়ন চাইলে তা কি থামানো যায় না?

গেল বছর জুলাই বিপ্লবের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এতে প্রতিক্রিয়া দেন। সেকেন্ডারি সোর্স নয়, বরং মাঠ পর্যায় থেকে সংবাদ সংগ্রহে ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও নতুন বাংলাদেশের গ্রাফিতি দেখে যেতে বলেন। এ আহ্বানের সাড়া মেলেনি। সেইসাথে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে অপপ্রচার তো চলছেই। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ করা  হয়। তারি কোনো উত্তর নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে প্রভাব নেই, এই বার্তাটি তাদের কাছে পরিস্কার। বহুল আলোচিত ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ছুটে চলে এসেছিলেন তখনকার ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। এর আগে ২০০৮ এবং পরে ১৮ সালে বিনাভোট এবং ২৪ সালে ডামি-আমি নির্বাচনের প্রভাব ছিল তাদের। কারো কারো বিশ্লেষণে বলা হয়,  ভারতের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ‘আমি তুমি ডামি’ ফর্মুলা দিয়ে দলের মধ্যে চরম বিভক্তি এনে আওয়ামী লীগের ধংস অনিবার্য করে তোলে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে তাই ভারতের সামনে কঠিন অঙ্ক থাকাই স্বাভাবিক। তারা ‘ইনক্লুসিভ’ কথাটা খুব ব্যবহার করছে। ইনক্লুসিভ মানে অন্তর্ভুক্তিমূলক। মানে আওয়ামী লীগ না থাকলে নির্বাচনটি ‘ইনক্লুসিভ’ নয়। ঢাকা থেকে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে তা আরো খোলাসা করে দেয়া হলো। জানানো হলো আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকলে সেটাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক বিবেচনা করবে না দিল্লি। সেক্ষেত্রে নির্বাচনও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

ভারতের বিজেপি সরকারের সাথে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই পরিচালিত হয়েছে। দুই দেশের জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ককে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপেক্ষা করার কেমিস্ট্রিটা যে ভুল তা গত পনের বছরে ঢাকা ও দিল্লি সম্পর্ক প্রমাণ করেছে এবং এরই নির্যাস হচ্ছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ভারত ও বাংলাদেশের গরজের বিষয়ও রয়েছে। বিজেপি ও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সম্পর্কের প্যাচআপ করেছিল। এর ফলাফল দু’টি দেশের সাধারণ মানুষ বুঝেছে। রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক বা ভৌগোলিক কোনো দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক আটকে রাখা যাবে না। ইলিশ কিংবা চাল এগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে দু’টি দেশের কোষাগারে যেমন রাজস্ব যাচ্ছে, তেমনি পণ্য আদান-প্রদানের মধ্যে দু’টি দেশের মানুষ কাছাকাছি যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে যে বাংলাদেশী মৎস্যজীবী ভাইটি ইলিশ ধরে বরিশাল বাজারে বিক্রির পর তা রফতানি হচ্ছে ভারতে আবার বর্ধমানে চাষির উৎপাদিত চিনিগুঁড়া চাল আসছে বাংলাদেশে।

সময়টা স্পর্শকাতর। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ক’দিন আগে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এর পেছনে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও কার্যক্রমের বিষয়টি অন্যতম। ‘ভারতীয়রা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কিছু বিষয় পছন্দ করেনি। এর ফলে সম্পর্কের মধ্যে টান পড়েছে।’ এর পাশাপাশি তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের অবস্থানের কথাও উল্লেখ করেন। ইউনূসের অভিযোগ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও তরুণদের মৃত্যুর জন্য দায়ী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। এ বিষয়টি সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীতে যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা সুসংহত করতে এবং জনগণের চূড়ান্ত মুক্তির জন্য আরও রক্ত ঝরাতে হয়েছে। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। ভোটের আন্দোলন করতে করতেই দেশটির মানুষের জীবন সারা হতে থাকবে? সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করতে হলে জনগণকেই মাঠে নামতে হবে, যেমনভাবে তারা নেমেছিলেন ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪-এ। ভোটের অধিকারের জন্য জনগণকে লড়াই করতে হয়েছে এবং সে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেখানে সতর্কতার কারণেই ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। গণতন্ত্র পেতে যাচ্ছিল্ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। কিন্তু তা হয়নি।  ২০০৮ সালের বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জনকে বিজয়ী ঘোষণা, ২০১৮ সালে দিনের ভোট আগের রাতে দেওয়া এবং ২০২৪ সালে ‘আমি তুমি ও ডামি’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ পোক্তকরণে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন অস্বীকার করা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলে এর একটা বিহিত বা অবসান আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *