‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় ভারতীয় মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন

অনলাইন ডেস্ক :

ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যে পুলিশ গত এক মাস ধরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা বার্তাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। বাড়ি-ঘরে হানা দেওয়া হচ্ছে, মুসলিম পুরুষদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, কখনও কখনও সম্পত্তি নষ্ট করা হচ্ছে। এই ঘটনা শুধু আইন প্রয়োগের বাইরে গিয়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় ৪ সেপ্টেম্বর, উত্তর প্রদেশের কানপুরে। মহানবী (সা.)–এর জন্মদিন উপলক্ষে এক মহল্লায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা একটি বোর্ড টাঙানো হয়। কিছু হিন্দু বাসিন্দা এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ‘অপ্রীতিকর সংযোজন’ হিসেবে দাবি করেন এবং স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। পুলিশ পরে জানান, বোর্ডটি ‘ধর্মকে ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়ানোর উপাদান’ এবং ‘সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে’।

ঘটনার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ইমামরা বিক্ষোভ ডাকেন, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে বেরেলিতে ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এবং ইমাম ও তাদের সহযোগীদের বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এমনকি পোস্টার, টি-শার্ট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা থাকলেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। প্রায়শই অভিযোগের মধ্যে আছে-আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ, ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানো এবং জনসমাগমকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার।

কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা কি বেআইনি? ভারতের সংবিধান ধর্ম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করেছে। ধারা ২৫ অনুযায়ী ধর্ম পালন করার অধিকার এবং ধারা ১৯(১)(ক) অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। যদি কোনো বক্তব্য সরাসরি সহিংসতা বা ঘৃণা উসকে না দেয়, তবে আইন অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য নয়। তবে স্থানীয় প্রশাসন দাবি করছে, এই বাক্য ‘হুমকি সৃষ্টি করছে’ এবং গ্রামে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।

অলাভজনক সংস্থা এপিসিআর জানিয়েছে, এই ধরনের রাজ্যগুলিতে ইতিমধ্যেই ২২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই হাজারেরও বেশি মুসলিমকে আসামি করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ৪০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এপিসিআর-এর সমন্বয়ক নাদিম খান বলেন, কর্তৃপক্ষ জানে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ নিজে কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু বিভিন্ন আইন ব্যবহার করে ব্যক্তিদের দমন করা হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যদি কেউ হিন্দু দেবতার ছবি হাতে ধরে, তাহলে কি তা মুসলিমদের জন্য ‘হুমকি’ হিসেবে গণ্য হবে?

মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদির নেতৃত্বে ভারত সামাজিক ও সাংবিধানিক ক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ অভিব্যক্তি যেমন ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ দমন করা সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নাম করে ধর্মীয় চর্চা ও বিশ্বাসকে দমন করা ঠিক নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো মানুষের মানবিক অধিকার রক্ষা করা, বিশ্বাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা নয়।

প্রতিবছর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্যের ঘটনা বাড়ছে। ২০২৩ সালে এ ধরনের ঘটনা ছিল ৬৬৮টি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ১,১৬৫টি হয়েছে। অধিকাংশই বিজেপি শাসিত রাজ্যে ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো শান্তিপূর্ণ অভিব্যক্তি দমন করা স্থানীয় বিরোধগুলোকে দ্রুত ‘জাতীয় ধর্ম-রাজনৈতিক ইস্যু’ হিসেবে গড়ে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, কানপুরের ঘটনার পর বারানসীতে ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার লাগিয়ে দমনকারীদের সমর্থন প্রকাশ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *