অনলাইন ডেস্ক
নামের বৈশিষ্ট্য দিয়ে সিন্ধি পরিবারের সদস্যদের চেনা যায়। যেমন রাজনীতিবিদ লালকৃষ্ন আদভানী, আইনজীবী রামজেঠ মালানী, চলচ্চিত্রকার রাজকুমার হিরানী, নায়িকা হংসিকা মাতোয়ানী,পাকিস্তানের আসিফ আলী জারদারী। নামের শেষের বংশের চিহ্ন রাখতে পছন্দ করেন সিন্ধিরা। যদিও এই ধারার বাইরেও অনেক বিখ্যাত সিন্ধি আছেন, পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো, রেকর্ড সৃষ্টিকারী শোলে সিনেমার পরিচালক রমেশ সিপ্পি, ব্যবসায়ী পরিবার হিন্দুজা, নায়ক রনবীর সিং ও গোবিন্দ প্রমুখ।
ভারত ও পাকিস্তান বিভাজনের আগে, সিন্ধু প্রদেশের শহর ও নগরগুলোতে সিন্ধি পরিবারের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। দেশভাগের পর, বেশিরভাগ হিন্দু সিন্ধি ভারতে চলে আসে এবং একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে বসবাস শুরু করে। সিন্ধি জনগোষ্ঠী মূলত ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করে, যেমন – রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশ, সেইসাথে নয়াদিল্লিতেও এদের দেখা যায়। সাজ আগরাওয়ালের বই-এ (Sindh: Stories of a Vanished Homeland) বিভাজিত সিন্ধি জনগোষ্ঠীর যন্ত্রণা, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে।
ভারতে অভিবাসী সিন্ধি জনগোষ্ঠী প্রধানত ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে দ্রুত আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেন। উল্লেখ্য, ভারতে গুজরাতী, মাড়োয়ারী ও সিন্ধিদের ব্যবসাক্ষেত্রে নেতৃত্বের স্থানে দেখা যায়, যদিও অন্যান্য পেশায় শ্রেষ্ঠত্বের আসন পেয়েছেন অনেক সিন্ধি জাতির সদস্য। যাদের একজন আসরানী, গোবর্ধন আসরানি (১ জানুয়ারি ১৯৪১ – ২০ অক্টোবর ২০২৫)। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, জনপ্রিয় ও দীর্ঘস্থায়ী কৌতুক অভিনেতা ছিলেন। পাঁচ দশকেরও বেশি দীর্ঘ কর্মজীবনে ৩৫০টিরও বেশি ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। সিন্ধি পরিবারের আসরানীর হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল বেদনার ছায়া।
পাকিস্তানের সিন্ধু থেকে ভারতে এসে রাজস্থানের জয়পুরে বসতি স্থাপন করে আসরানীর পরিবার। তার বাবা কার্পেটের দোকান চালাতেন। তার চার বোন ও তিন ভাই; ভাইদের মধ্যে দুইজন তার বড় এবং একজন ছোট। আসরানী ব্যবসায় আগ্রহী ছিলেন না এবং গণিতে দুর্বল ছিলেন। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন এবং রাজস্থান কলেজ, জয়পুর থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি তার শিক্ষার খরচ চালাতে একাধারে অল ইন্ডিয়া রেডিও, জয়পুরে ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন।

১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের আগে আসরানী পুণেরফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তার অভিনয় দক্ষতা আরও উন্নত করেন। তিনি কর্মজীবনের শুরুতে গুরুতর ও পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও খুব শীঘ্রই তার কৌতুক প্রতিভা প্রকাশ পায়। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে তিনি হিন্দি সিনেমার এক অপরিহার্য মুখ হয়ে ওঠেন। হিন্দি সিনেমার মাইলফলক ছবি ‘শোলে’-তে হিটলারের অনুকরণকারী ভোলাভালা জেলারের চরিত্রে তার অভিনয় ছিল অন্যতম স্মরণীয়। এই চরিত্রটি ভারতীয় ফিল্মি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে আছে। কৌতুকের বাইরেও আসরানি মাঝে মাঝে ‘আজ কি তাজা খবর’ এবং ‘চলা মুরারি হিরো বন্নে’-এর মতো ছবিগুলোতে তার নাটকের ক্ষমতা দেখিয়েছেন, যেখানে তিনি পরিচালনার দায়িত্বও পালন করেন। আসরানি গুজরাটি এবং রাজস্থানি ছবি সহ বিভিন্ন ভাষা ও ঘরানায় কাজ করে তার বহুমুখিতা প্রমাণ করেছেন।
হিন্দি সিনেমার গোবর্ধন আসরানি ছিলেন এমন এক মুখ, যিনি পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে স্মৃতির পেছনের পর্দায় বেঁচে ছিলেন—তাঁর তীক্ষ্ণ সংলাপ উচ্চারণ ও সংক্রামক হাসির জন্য চিরস্মরণীয়। তিনি ছিলেন সেই চিরন্তন “সাইড আর্টিস্ট”, যিনি কিংবদন্তি অভিনেতাদের সঙ্গে একই ফ্রেমে থেকেও দৃশ্য চুরি করতে পারতেন। ফলে তিনি একটি ঘরানা ও অধ্যায়ের জন্ম দিতে সক্ষম হন। তিনি যে শিল্পে প্রায়ই মূল নায়ককে কেন্দ্র করে প্রশংসা গড়ে ওঠে, সেখানে চরিত্রাভিনেতার বিপ্লব সম্পন্ন করেন এবং লাইম লাইটে চলে আসেন।
শোলে (১৯৭৫) ছবির চরিত্রের জনপ্রিয়তা ভেঙে তিনি কোশিশ-এর আবেগ, চুপকে চুপকে-এর হাস্যরস, অমর আকবর অ্যান্থনি, হেরা ফেরি, ও আন্দাজ আপনা আপনা-এর উন্মত্ততা—সব ক্ষেত্রেই অসাধারণ বহুমাত্রিকতা দেখিয়েছেন। তাঁর রসবোধ কখনো তুচ্ছ ছিল না; বরং তা এসেছিল মধ্যবিত্ত ভারতের অদ্ভুত ও হাস্যকর বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ থেকে এবং জীবনের জীবন সংগ্রাম, অস্তিত্বের বিদীর্ণ দর্পণ থেকে প্রতিবিম্বিত হয়ে।
অভিনয়ের পাশাপাশি, আসরানি ছিলেন একজন দক্ষ পরিচালকও। তিনি ছয়টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন—চলা মুরারী হিরো বাননে (১৯৭৭), সালাম মেমসাব (১৯৭৯), হাম নাহি সুধরেঙ্গে (১৯৮০), দিল হি তো হ্যায় (১৯৯২), ও উড়ান (১৯৯৭)। তার পরিচালনায় জীবনে একই সঙ্গে সরলতা ও জটিলতার প্রতিফলন ছিল। ছিল হাস্যরস, মানবসম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতার নান্দনিক রসায়ন।
তার অভিনয়শিল্পের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল বহুমাত্রিকতায়। তিনি ছিলেন সেই সেতুবন্ধ, যিনি ৭০-এর দশকের বচ্চন-খান্না যুগকে ৯০-এর দশকের গোবিন্দা-সালমান যুগের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। তার অভিযোজন-ক্ষমতা তাকে দশকের পর দশক রুপালি পর্দায় প্রাসঙ্গিক রেখেছিল। তার প্রতি দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও আকর্ষণ ছিল অটুট। তিনি ৭০-এর দশকের ঋষিকেশ মুখার্জি-বাসু চ্যাটার্জি সংবেদনশীলতার সঙ্গে ৯০-এর দশকের আধুনিক ‘মসলা সিনেমা’-কে যুক্ত করেছিলেন।
আসরানীর অনুপস্থিতি কেবল নামমাত্র অনুপস্থিতি নয়। বরং এক ধরনের উপস্থিতির শূন্যতা। খুব কম অভিনেতাই আছেন যারা এক দৃষ্টিতে হাসি, মমতা ও নস্টালজিয়া জাগাতে পারেন। পরিবর্তমান চলচ্চিত্রশিল্প, যেখানে ফ্র্যাঞ্চাইজ লজিক রাজত্ব করছে, সেখানে আসরানির মতো অভিনেতার ওপর যে আস্থা রাখা যেত, তা বিরল হয়ে পড়েছে। তার অবর্তমানে নির্মাতাদের আবার খুঁজতে হবে সেই শান্ত অথচ বহুমাত্রিক পারফর্মারকে। যে পারফর্মার কমেডি ধারাকে গঠন করার সাহস ও দক্ষতা রাখেন এবং চরিত্রাভিনেতাদের মর্যাদার আসনে উত্তীর্ণ করেন। তিনি ছিলেন সেই অভিনেতা, যারা গল্পের ভেতর মানবিক বুনন তৈরি করেন, গল্পে হৃদয়, গভীরতা ও বাস্তবতার সুর যোগ করেন।
বলিউডের স্মরণীয় পরিচালক ঋষিকেশ মুখার্জি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “না রাজেশ খান্না, না ধর্মেন্দ্র, এমনকি অমিতাভ বচ্চনও নয়—ছবির মূলশক্তি আসরানি। কী অসাধারণ প্রতিভা! যাকে যেভাবে দাও, সেভাবেই তৈরি হয়ে যায়। আমি অস্থির হয়ে পড়ি, যদি আমার ছবিতে ওকে না পাই।”
এমন অভিজ্ঞতাপত্র যিনি লাভ করেছেন, তার প্রয়াণ শৈল্পিক দরজা বন্ধ হওয়ার মতো—যেটি খুললেই হাসি শোনা যায় জীবন ও বাস্তবতার সমান্তরালে।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর এই বর্ষীয়ান অভিনেতার মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। সান্তাক্রুজ শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে অভিনেতা তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্টে ভক্তদের দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি পোস্ট করেছিলেন। তবে, শেষকৃত্য গোপন রাখার ইচ্ছা কেবল বিনয়ের প্রতিফলিত নয়, বেদনার ছায়া আড়ালের প্রচেষ্টা, যা তিনি দেশভাগ, জন্মভূমি হারানোর ক্ষতের মাধ্যমে ভোগ করেছেন। এজন্যই তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কোনো হৈচৈ না হোক। এমনই বিদায় মানানসই ছিল এক এমন অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ অভিনেতার জন্য, যিনি কখনো মনোযোগ চাননি, কিন্তু তার গুণ ও শিল্পের জন্য সেটি অর্জন করেছিলেন।
















Leave a Reply