অনলাইন ডেস্ক
রোকনুজ্জামান কাকন। সবাই ডাকেন ‘ইঞ্জিনিয়ার কাকন’। কুষ্টিয়া, পাবনার ঈশ্বরদী, সুজানগরের নাজিরগঞ্জ, নাটোরের লালপুর এবং রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাটের বিস্তীর্ণ চরে এখন ভয়ংকর তিনি। কাকন বাহিনীর ভয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারেন না জেলেরা। সাধারণ কৃষক চরের জমিতে করতে পারছেন না চাষবাস। সিরাজ সিকদার, লালচান ও পান্না বাহিনীর পর কাকন এখন পদ্মার চরে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।
গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর কাকন আত্মগোপনে চলে গেলেও সম্প্রতি ফের বেপরোয়া তাঁর বাহিনী। চরবাসীর অভিযোগ, কাকন বাহিনী কথায় কথায় গুলি করে মানুষ হত্যা করে। চর দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন ও আধিপত্য বিস্তার করতে অস্ত্রের মহড়া, গুলি, ডাকাতি, নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। গত ছয় মাসে কাকনসহ বাহিনীর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদী থানাতেই ছয়টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া লালপুর ও বাঘা থানায় একাধিক মামলা আছে।
কে এই কাকন
কাকন ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মরিচা ইউনিয়নের মাজদিয়া গ্রামের জমির মাস্টারের ছেলে কাকন থাকেন কখনও পাবনার ঈশ্বরদীতে, আবার কখনও নাটোরের লালপুরে। তাঁর বাহিনীতে তিন সন্ত্রাসী বেশ সক্রিয়। তারা হলেন ঈশ্বরদী যুবলীগ নেতা মিলন চৌধুরী, কুষ্টিয়ার কালু ও মুকুল। তারা এক হয়ে ‘কাকন বাহিনী’। এর মধ্যে মুকুল এখন কারাবন্দি। ফলে কাকন, মিলন ও কালু মিলে বাহিনী চালাচ্ছেন। বাহিনীতে রয়েছে শতাধিক অস্ত্রধারী সদস্য।
একসময় দক্ষিণাঞ্চলের ‘ত্রাস’ সিরাজ সিকদারের সঙ্গে একই পথে চলাচল থাকলেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কাকন ও কালু বাহিনী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। পরে নিজ এলাকা ছেড়ে ঈশ্বরদীর ভাটাপাড়া এলাকায় থাকতে শুরু করেন কাকন। আধিপত্য বজায় রাখতে লালচান ও পান্না বাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে ঈশ্বরদী ও লালপুরের পদ্মা চরাঞ্চলে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন কাকন। ২০০৬ সালে পান্না ও লালচান কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এরপর দুই বাহিনীর অন্তত ৩২ সদস্য কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়েন। এ সময় কাকন বিদেশে পালিয়ে যান। ২০০৯ সালে কাকন ও কালু দেশে ফিরে এসে দল গঠন করেন। ২০১৪ সালে ‘ক্রসফায়ারের ভয়ে’ ফের দেশ ছাড়েন কাকন। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে এলাকার পুরোনো লোকজনকে এক করে ফের সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ান। সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় লালপুরের পদ্মা নদীতে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে উত্থান হয় কাকনের।
আগে লালচানের উত্থান হয়েছিল কুষ্টিয়ার দৌলতপুর আবেদের ঘাট ও চরের জমি দখল করে। আর বাঘা-লালপুরের চরের জমি দখল করে পান্না বাহিনীর নাম সামনে আসে। তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ, দখলবাজি, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বাঘা, দৌলতপুর ও লালপুর থানায় একাধিক মামলা ছিল।
একের পর এক খুন, হামলা
গত সোমবার রাজশাহীর বাঘায় কাকন বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে দুজনকে হত্যা করে। এর আগে গত ২৬ মে ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাটে বালুমহাল দখল করা নিয়ে কাকন বাহিনীর গুলিতে ছয়জন বিদ্ধ হন। গত ২৮ মে কয়েকজন কৃষককে পিটিয়ে দুটি গরু ছিনতাইয়ের পর সেগুলো চরে জবাই ও ভূরিভোজ করে বাহিনীর সদস্যরা। গত ৫ জুন সাঁড়াঘাটের ইসলামপাড়া বালুমহালে গুলি চালিয়ে নদীর আশপাশের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। গত ১১ জুন পদ্মা নদীতে চর দখল করতে এসে গোলাগুলির সময় কাকন বাহিনীর ছয় সদস্যকে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত ২১ জুন সাঁড়াঘাটে গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং ১২ জুলাই চরে এক রাখালকে গুলি করে কাকনের লোকজন। গত ৬ অক্টোবর পদ্মা নদীতে হামলা চালিয়ে তরিয়া মহলের ইজারাদার মেহেদী হাসানের নৌকা ও স্পিডবোট ছিনতাই করা হয়। এ সময় অতর্কিত গুলিতে নদীর পাড়ে কাজ করার সময় দুই কৃষক গুলিবিদ্ধ হন।
ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাটের রানা খরিয়া তরিয়া মহল ঘাটের ইজারাদার মেহেদী হাসান জানান, তিনি গত বৈশাখে ৪৭ লাখ টাকা দিয়ে তরিয়া ঘাট ইজারা নেন। অথচ কাকন বাহিনী তাঁর ঘাট দখলে নিতে অন্তত পাঁচবার হামলা চালিয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, গত বছর ৫ আগস্টের পর কাকন বাহিনী কুষ্টিয়ার কালু ও মুকুলকে একসঙ্গে নিয়ে জোট গঠন করে। তিন গ্রুপ এক হয়ে কাকন বাহিনীর নামে নদীতে রাজত্ব করছে।
নৌ পুলিশ, ঈশ্বরদী থানা পুলিশ ও বালুমহাল-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বালু উত্তোলন নিয়ে ভেড়ামারা প্রান্তের ইজারাদার কাকন আলী ও ঈশ্বরদী প্রান্তের ইজারাদার সুলতান আলী বিশ্বাস টনির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছিল। কাকন বাহিনীর সদস্যরা স্পিডবোট ও নৌকায় করে এসে ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাট এলাকায় মাঝেমধ্যেই গুলি করে। গত ২২ মে সকালে বালুমহাল দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলিতে সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়। ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাট বালুমহালের ইজারাদার সুলতান আলী বিশ্বাস টনি বলেন, চরের আট কৃষককে পিটিয়ে জখম এবং কৃষকের গরু লুট করে কাকন বাহিনী।
ঈশ্বরদীর পদ্মার চরাঞ্চলে কৃষকের ওপর হামলা, গুলি, গরু লুটের বিষেয় ভুক্তভোগী কৃষক আবদুল মোত্তালিব বলেন, কাকন বাহিনীর লোকজন মাঝেমধ্যেই গুলি করে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। পদ্মার চরে কেউ গেলে বা জেলেরা নদীতে মাছ ধরার আগ্রহ দেখালে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদ্মার বিশাল চরে শত সন্ত্রাসী নিয়ে আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে। মাঝেমধ্যেই দলবল নিয়ে ঘাটে এসে তারা প্রকাশ্যে কৃষকের ওপর গুলি করে। গত ছয় মাসে এলাকার অন্তত ১৫ কৃষক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ঈশ্বরদীর পদ্মা নদীর তরিয়া মহলে ইজারার টোল আদায় করার সময় গত ৬ অক্টোবর হামলা চালিয়ে ইজারাদার মেহেদী হাসানের নৌকা ও স্পিডবোট ছিনতাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পদ্মা নদীতে স্পিডবোট নিয়ে নিয়মিত সশস্ত্র মহড়া দেয় কাকন বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি তাদের মহড়ার ঘটনা ড্রোন দিয়ে ভিডিও করে প্রশাসনকে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা সংগৃহীত
পদ্মা নদীতে স্পিডবোট নিয়ে নিয়মিত সশস্ত্র মহড়া দেয় কাকন বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি তাদের মহড়ার ঘটনা ড্রোন দিয়ে ভিডিও করে প্রশাসনকে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা সংগৃহীত
পাকশী ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মনিরুল ইসলাম বলেন, সোহেল খন্দকার নামে কুষ্টিয়ার এক চ্যানেল ইজারাদারের সঙ্গে ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাটের তরিয়া মহলের ইজারাদার মেহেদী হাসানের পূর্ববিরোধের জেরে এই গুলি ও স্পিডবোট ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। কাকন বাহিনীর ভয়ে কৃষকরা পদ্মার চরে কৃষিকাজ এবং জেলেরা মাছ ধরতে পারছেন না।
ঈশ্বরদী থানার ওসি আ স ম আবদুন নূর বলেন, কাকনের বিরুদ্ধে মামলাগুলো নদী ও সাঁড়াঘাটকেন্দ্রিক হওয়ায় নৌ পুলিশকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর আগে গোলাবারুদসহ কাকন বাহিনীর ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ওসি।
রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, গত সোমবার গুলি করে দুজনকে হত্যার ঘটনায় দৌলতপুর থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে কাকন বাহিনী। আমাদের কাছে তথ্য আছে, কাকন থাকেন ঢাকায়। চরে অভিযান চালালে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হতে পারে। তাই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে শিগগিরই কাকন বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।













Leave a Reply