অনলাইন ডেস্ক
রংপুর সিটি করপোরেশনের সড়ক সংস্কারসহ ১৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এতে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে দিন দিন নগরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শহীদ আবু সাঈদের রংপুরকে উন্নয়নে দেশের এক নম্বর জেলা হিসেবে গড়ে তোলার আশ্বাস দিলেও বাস্তবতার ফল শুন্য।
ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১৬ মাস পেরিয়ে গেলেও উন্নয়ন প্রকল্প ফাইলবন্দি অবস্থায় থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতনরা। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে রংপুরকে পিছিয়ে রেখে উন্নয়নের তকমায় সমৃদ্ধ হওয়ার মানসিকতা থেকে সরকারের উপদেষ্টা ও আমলাদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।
রংপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে রংপুর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ নগরীর উন্নয়নে রাস্তা বর্ধিতকরণ, সংস্কার ও মেরামত, রাস্তার পার্শ্ববর্তী ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্যামাসুন্দরী খালের ওপর দিয়ে চলাচলের ব্রিজ নির্মাণসহ সড়ক সংশ্লিষ্ট নানা উন্নয়ন কাজের জন্য ২০২১ সালে স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ৬৫৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। পতিত শেখ হাসিনার সরকার বারবার আশ্বাস দিয়েও সেই প্রকল্পটি বিভিন্ন অজুহাতে একনেকে অনুমোদন দেয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই প্রকল্প অনুমোদনের আশায় বুক বেঁধেছিলেন নগরবাসী। চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে রংপুর সিটি করপোরেশনের ওই প্রকল্পটি পাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের একটি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘রংপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি আপাতত বাস্তবায়নের প্রয়োজন নেই। এরপর থেকে ওই প্রকল্পটি ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
রংপুর সিটি করপোরেশনে সড়কপথ রয়েছে ১ হাজার ৪৫৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৯৫৩ কিলোমিটার পাকা ও ৫০৩ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। ৯৫৩ কিলোমিটার পাকা সড়কের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার অংশ ভাঙাচোরা। সে হিসেবে পাকা সড়কের এক-তৃতীয়াংশই বর্তমানে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খানাখন্দে ভরা এসব রাস্তায় প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। দীর্ঘদিনেও সংস্কার না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন নগরবাসী।
নগরীর জাহাজ কোম্পানি থেকে সাতমাথা সড়ক, সার্কিট হাউস সড়ক, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বুড়িরহাট সড়ক, মেডিকেল থেকে মডার্ন মোড় পর্যন্ত সড়কে অসংখ্য খানাখন্দে ভরা। এ ছাড়া, সিগারেট কোম্পানি থেকে হাই-টেক পার্ক, চারমাথা থেকে ইসলামপুর, তিনমাথা, স্টেশন রোড, নিউ জুম্মাপাড়া, কুকরুল, মিস্ত্রিপাড়া, বাবুপাড়া রোড, এরশাদ মোড়, হাজীরহাট, তাজহাট, মাহিগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত। কোথাও কোথাও পুরো সড়কের পিচ-খোয়া উঠে গেছে। সড়কে সৃষ্টি হওয়া গর্তে পানি জমে খালে পরিণত হয়েছে।
ভাঙাচোরা সড়কে যাতায়াত করা নগরবাসী প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। যানবাহন চালকরাও পড়েছেন বিপাকে। এসব সড়কে প্রতিদিন চলাচলের কারণে রিকশা, অটোরিকশা, কার, মাইক্রো, ট্রাকসহ নানা যানবাহন বিকল হয়ে পড়ছে। গেল বর্ষায় খানাখন্দ ও পানি জমে থাকা সড়কে শতাধিক নারী-পুরুষ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন। চলতি শুষ্ক মৌসুমে ভাঙা সড়কের ধুলায় নাকাল নগরবাসী। ধুলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা, শ্বাসকষ্ট, চোখের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা।
সড়ক সংস্কারে নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। বিশেষ করে জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে সাতমাথা মোড় পর্যন্ত সড়কটি চলাচলের একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা সিটি করপোরেশনের গায়েবানা জানাজা, সড়কে ধান রোপণ করেছেন। এর পরও অর্থ সংকটের কারণে সিটি করপোরেশন সড়কটি মেরামত করতে পারেনি।
একই সময়ে ৬০০ কিমি দূরত্বের দুই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন কনা?
আসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় বিএনপি, বাগড়া দিতে প্রস্তুত জামায়াত-এনসিপি
আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখতে চাই : আবু সাঈদের বাবা
জাহাজ কোম্পানি মোড়ে কথা হলে রিকশাচালক নুরুল হক বলেন, এক গর্ত শেষ না হতেই আরেকটা শুরু হয়। এসব রাস্তা দিয়ে গেলে রিকশার চাকা ভেঙে যায়, যাত্রীও পড়ে যায়। প্রতিদিন কারো না কা গাড়ি উল্টে থাকে। সড়কটি সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সিগারেট কোম্পানি যাওয়ার সড়কটি পুরো অংশের পিচ-খোয়া উঠে গেছে। ঝুঁকি নিয়ে হেলেদুলে চলাচল করছে যানবাহন। এ সড়কে কথা হয় শামছুল মিয়ার সঙ্গে। পেশায় ব্যবসায়ী এই ব্যক্তি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। হেঁটে যাওয়ার মতো উপযোগী নয়, কিন্তু সড়ক সংস্কারে কেউ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। রিকশা উল্টে যাচ্ছে। ভাঙা গর্তে পড়ে মোটরসাইকেল আরোহীর হাত-পা ভেঙে যাচ্ছে।
নগরীর শাপলা চত্বর এলাকার কলেজছাত্রী মাসুমা আক্তার বলেন, বিভাগীয় নগরী রংপুর অথচ রাস্তাঘাট দেখে বোঝার উপায় নেই এটি বিভাগীয় শহর। এর চেয়ে কোথাও কোথাও গ্রামের রাস্তা অনেক ভালো রয়েছে। শহরে ভাঙাচোরা রাস্তার জন্য প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে।
বুড়িরহাট রোডে নিয়মিত চলাচল করেন তাজিদুল ইসলাম। সড়কটির বেহাল দশায় ক্ষুদ্ধ তিনি। বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারও উন্নয়নের তকমায় রংপুরকে পিছিয়ে রেখেছে দাবি করে তিনি বলেন, বুড়িরহাট রাস্তাটা ভাঙাচোরা হওয়ায় চলাচল করা খুবই কষ্টকর। যারা যাত্রী পরিবহন করে তাদেরও অনেক কষ্ট হয়। প্রায় সময় অটোরিকশার বিয়ারিংসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, বুড়িরহাট সড়কটি নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়কগুলোর একটি। এই সড়ক ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাটের কালীগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিদিন লক্ষাধিকের বেশি মানুষ যাতায়াত করে থাকেন। ছোট যানবাহনের পাশাপাশি ভারি যানও চলাচল করে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলেন। সেটি একনেকে ওঠার পর তৎকালীন সেইসব প্রকল্প রিভাইস করে চাওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি পুনরায় প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিার ক্ষমতাচ্যুত হলে প্রকল্পটি ঝুলে যায়। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও ওই প্রস্তাবনা আবারও পাঠানো হয়। কিন্তু সরকার সেটি এখন পর্যন্ত পাস করেনি।
রংপুর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজম আলী বলেন, সড়ক সংস্কারসহ ১৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে সেটি পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে নগরীর সড়কসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। আশা করছি, দ্রুতই প্রস্তাবনাটি একনেকে পাস হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা জানি, মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে; কিন্তু বরাদ্দ না পেলে আমরা কিছুই করতে পারি না। তবু ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করে অস্থায়ীভাবে মেরামতের চেষ্টা করছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুরের জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর সংস্কারকাজে অর্থ বরাদ্দে অবহেলা, ফাইল আটকে রাখার প্রবণতা বিগত সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিতলার বহিঃপ্রকাশ। আমরা ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই জটিলতা থাকবে না। কিন্তু গত ১৬ মাসে রংপুরের জন্য এই সরকার কিছুই করেনি। অথচ প্রধান উপদেষ্টা রংপুরকে এক নম্বর জেলা বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা কারো প্রতিশ্রুতি আশ্বাস চাই না। আমরা ন্যায্যতা চাই, বরাদ্দ চাই, উন্নয়ন বৈষম্য থেকে মুক্তি চাই।













Leave a Reply