লালমনিরহাটে ঝড়ে লন্ডভন্ড ৫ শতাধিক বাড়িঘর, আহত ৫

লালমনিরহাট প্রতিনিধ

লালমনিরহাটের দুই উপজেলার ওপর দিয়ে আকস্মিক শক্তিশালী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সড়কের বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন।

গতকাল বুধবার মধ্যরাতে আদিতমারী ও কালীগঞ্জ উপজেলায় মাত্র ১৫-২০ মিনিটের এই ঝড়ে বিভিন্ন ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক কাঁচা ও আধা-পাকা ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

ঝড়ের সঙ্গে ছিল প্রবল শিলাবৃষ্টি, যাতে উঠতি বোরো ধান, ভুট্টা, পাটসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। গাছ উপড়ে পড়ে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়ক ও রেলরুটে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গতকাল মধ্যরাতে হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। মুহূর্তে প্রবল বেগে ঝড় ওঠে, সঙ্গে ছোট পরিমাণের শিলাবৃষ্টি। ঝড়ের তাণ্ডব চলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। এতে আদিতমারী ও কালীগঞ্জ উপজেলার পাঁচ শতাধিক কাঁচা ও আধা-পাকা ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সড়কের দুই ধারে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশ কিছু বড় বড় গাছ উপড়ে বাড়িতে ও সড়কে পড়ে। এতে ওইসব সড়কের যান চলাচল সমায়িক বন্ধ হয়ে যায়। ঝড়ের তাণ্ডবে বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার ছিঁড়ে যাওয়ায় দুই উপজেলায় রাত থেকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ। তবে দুপুরের পরে দুই উপজেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করতে সক্ষম হয় বিদ্যুৎ বিভাগ।

সরেজমিনে দেখা যায়, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের আয়নারপুল বটতলা এলাকার সড়কের পাশে জেলা পরিষদের বিশাল আকারের একটি বটগাছ উপড়ে দুটি বাড়ির ওপর চাপা পড়ে। এতে ওই এলাকার অন্তত পাঁচজন আহত হন। এর মধ্যে ওই গ্রামের আবু তালেবের স্ত্রী সেফালী বেগম গুরুতর আহত হলে তাঁকে আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। সড়কের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ বটগাছটি অপসারণ করতে কয়েক দফায় জেলা পরিষদে আবেদন জানান এলাকাবাসী। কিন্তু জেলা পরিষদ তাতে কোনো কর্ণপাত না করায় গতকাল রাতের ঝড়ে গাছটি উপড়ে পড়ে দুই বাড়ি ভেঙে যায়।

মহিষখোঁচা ইউনিয়নের আয়নারপুল বটতলা এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত আবু তালেব বলেন, ‘সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বটগাছটি অপসারণের জন্য কয়েক দফায় জেলা পরিষদে আবেদন করেছি। তারা গুরুত্ব দেয়নি। আজকে ঝড়ে গাছটি শিকড়সহ উপড়ে আমাদের দুই বাড়িতে চাপা দেয়। এতে আমার স্ত্রীর মাথা ফেটে যায়। দুই বাড়ির কোনো কিছুই রক্ষা হয়নি। সব ভেঙে চুরমার হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছি। আমাদের এ ক্ষতির দায় এড়াতে পারে না প্রশাসন।’

কালীগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কাকিনা ইউনিয়নে। কাকিনা হাট ও বাজারের বেশ কিছু দোকানঘরের ছাউনির টিন ঝড়ে ভেঙে উড়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে ব্যবসায়ীদের পণ্য। ঝড়ে মাটির দেয়াল ধসে পড়েছে এবং বহু পরিবার রাতারাতি আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। ঝড়ের তীব্রতায় অসংখ্য ছোট-বড় গাছপালা শিকড়সহ উপড়ে গেছে অথবা ডালপালা ভেঙে পড়েছে। এমন ভয়াবহ ঝড় অতীতে দেখা যায়নি বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। ঝড়ের তাণ্ডবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষজন।

ঝড়ের সঙ্গে হওয়া শিলাবৃষ্টিতে উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে পাকা বোরো ধান শিলাবৃষ্টির আঘাতে নুয়ে পড়েছে মাটিতে। এ ছাড়া ভুট্টা, পাট, আম, লিচু ও কলাবাগান এবং বিভিন্ন সবজি খেতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

কাকিনা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল করিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়া গেল বাহে! ধানের যে অবস্থা, আর ঘরে তোলার মতো নেই। ধারদেনা করি আবাদ করছিলাম। এমন অবস্থা আরও অনেক কৃষকের। ফসলের এই আকস্মিক ক্ষতিতে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

শক্তিশালী ঝড়ে অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়ে জেলার গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কসহ বিভিন্ন গ্রামীণ রাস্তায় যান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কালীগঞ্জ অংশে বেশ কয়েকটি গাছ পড়ে থাকায় সকালে কিছুক্ষণ যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকদের প্রচেষ্টায় গাছ সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।

এদিকে রেললাইনের ওপর বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ভেঙে পড়ায় লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলপথে প্রায় তিন ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে রেললাইন থেকে গাছপালা অপসারণের কাজ শুরু করে। সকাল নাগাদ রেলযোগাযোগ স্বাভাবিক হয় বলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যাওয়া ও তার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুই উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। বিদ্যুৎ না থাকায় খাবার পানি সংগ্রহ, মোবাইল চার্জ দেওয়া ও রাতের বেলায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাঁরা। দ্রুত লাইন মেরামতের কাজ চললেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে আরও কিছু সময় লাগবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে কিছু শুকনো খাবার বিতরণ করেছে। পাশাপাশি তালিকা তৈরির কাজ করছেন জনপ্রতিনিধি ও ত্রাণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে বা প্রতিবেশীদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দ্রুত পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলেও ঝড়ের রেখে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ‘ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বেশ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তাৎক্ষণিকভাবে সাড়ে সাত হাজার টাকা এবং কিছু চাল বিতরণ করা হয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলায়। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা পেলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের আবেদন উপেক্ষার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে জানিয়ে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সড়কে গাছ পড়ে দুটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও পাঁচজন আহত হওয়ার ঘটনায় ঘটনাস্থলে লোক পাঠানো হয়েছে। কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে সেটিও দেখা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *