অনলাইন ডেস্ক :
দীর্ঘ ৯০ দিন বন্ধ থাকার পর আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে বনবিভাগ থেকে জেলেদের পাশ পারমিট দেওয়ার মাধ্যমে উন্মুক্ত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন।
লম্বা বিরতির পর সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাচ্ছেন জেলেরা। কয়েকদিন আগে নৌকা মেরামত, নতুন করে রং করার পাশাপাশি বাজার-সদাইও করে নিয়েছিলেন তারা। চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সহযোগী জেলে নেওয়ার পাশাপাশি কোন আড়তে ও মহাজন ব্যবসায়ীর কাছে মাছ ও কাঁকড়া বিক্রি করবেন তার দর-দামও ঠিক করে নিয়েছেন।
৯০ দিন পর সুন্দরবনের দুয়ার খোলায় খুশি সুন্দরবন এলাকার জেলেরা, তবে অল্প স্থানে একসঙ্গে সহস্রাধিক বনজীবীর উপস্থিতিতে প্রত্যাশা মতো মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তারা।
খুলনার কয়রার কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে পাশ পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাচ্ছেন জেলে ইব্রাহিম মোড়ল। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ৯০ দিন পর ধার-দেনা করে বাজার-সদাই করে পাশ নিয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছি। আমরা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল।
পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-পরা থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও শিক্ষা খরচ আসে সুন্দরবন থেকে। বনে প্রবেশ বন্ধের কারণে ধার-দেনা করে ঋণের বোঝা ভারী হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনে না গিয়ে ঋণের বোঝা ভারী করলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও কম্পানি সিন্ডিকেট এ বছর নিষিদ্ধ সময়েও বিষ দিয়ে মাছ ধরেছে। তাছাড়া অল্প স্থানে হাজার হাজার জেলে একসঙ্গে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে।
সাথে বড় বড় কম্পানিগুলোর আধিপত্য তো আছেই। এ অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে মাছ পাওয়া নিয়ে সংশয়ে আছি। ঋণের বোঝা আরো ভারী হবে নাকি পরিশোধ করতে পারব, এসব নিয়ে খুবই চিন্তা হচ্ছে।’
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় গত ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদ-নদী, খাল ও বনে মাছ ধরা এবং পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই সময়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে জেলে ও বনজীবীদের নৌযান চলাচলও বন্ধ ছিল।
নিষেধাজ্ঞার কারণে হাজারো জেলে ও বনজীবী সংকটে পড়েন। পশ্চিম বনবিভাগের খুলনা রেঞ্জ ২ হাজার ৮৭১টি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে ৩ হাজার ২টি নৌকার বিএলসি নবায়ন করেছে। এসব নৌকায় করে বনজীবীরা মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করেন। তবে এখন শুধু মাছ ও কাঁকড়া শিকারিরাই বনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব প্রদান করা নৌকা ও ট্রলারগুলোতে বিশেষ রঙের সংকেত দেওয়া হয়েছে, যাতে অবৈধ নৌযান প্রবেশ করতে না পারে। সংকেতবিহীন কোনো নৌকা বা ট্রলার প্রবেশ করলে বন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলেরা জানান, বড় কম্পানিগুলোর আধিপাত্যের কারণে পছন্দের জায়গায় জাল ফেলা নিয়ে তারা উদ্বেগে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বনকর্মীদের টহল জোরদারসহ অভয়ারণ্যের আয়তন হ্রাস ও উপকূলজুড়ে বিকল্প কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার দাবি জানান তারা। বন্ধের সময়ে সংসার চালাতে স্থানীয় বিভিন্ন সমিতি, এনজিওসহ মহাজনদের থেকে তারা ঋণ নিয়েছেন। আবার জাল ও নৌকা প্রস্তুতের জন্য শরণাপন্ন হয়েছেন দাদন ব্যবসায়ীসহ মহাজনদের। এ অবস্থায় সিন্ডিকেটকে বনবিভাগ সহায়তা করলে তাদের না খেয়ে মরার উপক্রম হবে। সুন্দরবনে ঢুকে পছন্দের জায়গায় মাছ ও কাঁকড়া শিকারে কর্তৃপক্ষের সহায়তা চান তারা। বনকর্মীরা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে সর্বস্বান্ত হবেন তারা। দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের ঋণের বোঝা নিয়ে এলাকা ছাড়ার শঙ্কাতের রয়েছেন তারা। নিষিদ্ধ মৌসুমেও অনেকে বিষ দিয়ে মাছ ধরেছে। এ অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মাছ পাওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন তারা।
একাধিক জেলের সঙ্গে কথা হলে তারা অভিযোগ করে বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকাকালে আমরা চরম অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাই। এ সময় আয়-রোজগারের কোনো সুযোগ না থাকায় আমাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। সরকার থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বন্ধের সময় কিছু বনকর্তা সহায়তায় অসাধু দাদন ব্যববাসী ও কম্পানি সিন্ডিকেট বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করেছে।
উপজেলার বেকাশির কাটকাটা এলাকার জেলে শাহাবুদ্দিন সরদার বলেন, ‘সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে কাকড়া ধরতে যাচ্ছি। সুন্দরবন তো যাচ্ছি, কিন্তু বনদস্যুদের উৎপাত নিয়ে ভয়ে আছি। এ ছাড়া এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিরা রয়েছেন, পাস নিয়ে হরিণ শিকার ও বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে অভয়ারণ্য এলাকায় প্রবেশ করেন। আর সেই অভিযোগ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। যারা অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যায়, কিন্তু আমরা পড়ে যাই বিপদে। আমরা যাতে আর অহেতুক মিথ্যা বিপদে না পড়ি সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাই।’
বংশ পরম্পরায় সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল দক্ষিণ বেদকাশি এলাকার বাসিন্দা চল্লিশোর্ধ্ব জেলে মজিবর গাজি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-পরা থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও শিক্ষা খরচ আসে সুন্দরবন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে বছরে একাধিকবার বনে প্রবেশ বন্ধের কারণে আমাদের ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে। এ পর্যায়ে আশানারূপ মাছ না পেলে দুঃখের শেষ থাকবে না।’ বন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ মনোভাব ও সুন্দরবনের বিকল্প কর্মক্ষেত্র গড়ার পাশাপাশি সহজ শর্তে জেলে পরিবারের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।
মহেশ্বরীপুর তেতুলতলার জেলে সঞ্জয় মন্ডল ও আব্দুল গফুর জানান, এই তিন মাস তারা প্রায় অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন। পরিবার চালাতে এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। বর্তমানে তারা ট্রলার, জাল ও খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে সুন্দরবনে যাচ্ছেন। কাঙ্ক্ষিত মাছ পেলে তাদের অভাব-অনটন ঘুচবে বলে জানান তারা।
খুলনা পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রতি বছরের মতো এবারও ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটক ও বনজীবীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এ সময়ে মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় নদী-খালে মাছের প্রজনন বেড়েছে। সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ২০১৯ সাল থেকে ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানিংয়ের সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিবছর তিন মাস সুন্দরবন বন্ধ রাখা হয়। কিছু চোরা শিকারি ও অসাধু জেলে এ সময় বনে ঢোকার চেষ্টা করে। আমাদের কঠোর নজরদারিতে তা দমন করা হয়েছে। এর সুফলও মিলছে। আশা করছি, জেলেরা তাদের কাঙ্ক্ষিত মাছ পাবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার কাছে সবাই সমান। কারো কাছে বিক্রি হয়ে কোনো সিন্ডিকেটকে বাড়তি সুযোগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মৎস্যজীবী ও বনজীবীদের সহায়তার জন্য মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছিল, যা যাচাই করছে মৎস্য দপ্তর। আগামী বছর থেকে জেলেরা খাদ্য সহায়তা পাবেন।’













Leave a Reply