ফিলিস্তিন ভূমিতে ‘দ্বিতীয় দুবাই’ তৈরির স্বপ্নে বিভোর ট্রাম্প!

অনলাইন ডেস্ক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ২০ দফা শর্ত ঘোষণা করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল ও হামাস দুপক্ষই এই প্রস্তাবের ওপর সম্মতি দিয়েছে। তবু কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক সংশয় ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। তাদের ধারণা— শান্তির কথা বলে যে পরিকল্পনাগুলো উত্থাপিত হচ্ছে সেগুলোর আড়ালে থাকতে পারে গাজার রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি বৃহৎ নীলনকশা।
‘দ্বিতীয় দুবাই’কেন এই নাম?

ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে কিছু বিশ্লেষক ‘দ্বিতীয় দুবাই তৈরির স্বপ্ন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের যুক্তি গাজা ভূমধ্যসাগরের কূলে আছে, তাই এটা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার যোগাযোগের মাঝামাঝি। এই কারণে এখানে একটি বড় বাণিজ্য ও পরিবহন কেন্দ্র করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করা গেলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রাঞ্চলের লাভ অনস্বীকার্য হবে।

একই সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তাও জোরদার হবে।
সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা ‘বোর্ড অব পিস’

প্রস্তাবনার মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি হলো ‘বোর্ড অব পিস’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। এতে নজরদারির দায়িত্বে থাকার কথা বলা হয়েছে ট্রাম্প ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিদের। দুজনকেই সাধারণত ইসরায়েলভিত্তিক নীতির অনুকূলে ধরা হয়।

সমালোচকদের মতে, বোর্ডটি যদি কার্যকারিতা পায় তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া একমুখী ও পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকে মনে করেন এতে ইসরায়েলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং ফিলিস্তিনি স্ব-নির্ণয়ের অধিকার সীমিত হবে।
নিরাপত্তা, প্রশাসন ও ‘অন্তর্বর্তী সরকার’

ট্রাম্পের শর্তগুলোর মধ্যে হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ ও তাদের ঘাঁটি উচ্ছেদের নির্দেশনাসহ গাজায় একটি অন্তর্বর্তী আন্তর্জাতিক সরকার গঠনের কথাও আছে। প্রস্তাবে বলা হয়নি ওই সরকারে কে থাকবে বা তাদের প্রতিনিধিত্ব কিভাবে ঠিক করা হবে—এই কারণে কূটনীতিকরা চিন্তিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী গাজায় মোতায়েন করা হবে।

এরা স্থানীয় পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে এবং সাময়িকভাবে প্রশাসনিক ও সামরিক কার্যক্রম তদারকি করবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাস্তবে এতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তিদের হাতে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এটি ‘অস্থায়ী’ ও ‘সম্মিলিত’ বলে উপস্থাপন করা হবে।

হামাসের প্রতিবন্ধকতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

গাজায় স্থায়ী পরিবর্তন আনতে গেলে সবচেয়ে বড় বাধা হামাস। যারা নিজেদের রাজনৈতক উপস্থিতি ও ভৌত ভিত্তি ছাড়তে রাজি নয়। হামাস ইচ্ছুক এমন এক ব্যবস্থা সংস্কারে যেখানে গাজার নিয়ন্ত্রণ একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হবে এবং এই কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে ইসলামি ও আরব রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায়। পাশাপাশি তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবিও তুলতে পারে। অর্থাৎ, হামাসকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দেওয়া বা তাদের প্রভাবশালী অবস্থান বিনষ্ট করা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত জটিল এবং সামরিকভাবে কঠোর প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে।

প্রস্তাবনার সম্ভাব্য সুকৃতি— বন্দিমুক্তি ও পুনর্বাসন কর্মসূচি

প্রস্তাবনার মধ্যে কিছু গ্রহণযোগ্য ও ইতিবাচক ধারা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বন্দিমুক্তি। ইসরায়েলি বন্দিদের ফেরত দেওয়া ও আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিনিময়ে হামাস সম্মত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যা তাৎক্ষণিক মানবিক ক্যাপসুল হিসেবে কাজ করতে পারে। তদুপরি গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে—হাসপাতাল, সড়ক, পানীয়জল ও বিদ্যুৎসহ মৌলিক সুবিধা পুনর্নির্মাণ করা হবে, যা সামান্য হলেও জনজীবনে স্বস্তি আনা সম্ভব।

অর্থনৈতিক প্রলোভন বনাম ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

গাজার বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। এতে প্রয়োজন বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ, স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—কার স্বার্থে ও কার অনুকূলে এই বিনিয়োগগুলো হবে? অঞ্চলটিকে যদি বাণিজ্যিকভাবে ‘উন্নত’ করা হয়, তবে কে হবে প্রকৃত সুবিধাভোগী। স্থানীয় ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী নাকি আন্তর্জাতিক করপোরেট ও নিরাপত্তা অফসেট? অতীতের অনেক পুনর্গঠন প্রকল্প দেখিয়েছে, উন্নয়ন যদি স্থানীয় অংশগ্রহণ ও স্বার্থবণ্টন ছাড়াই করা হয়, তবে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ ও অনিশ্চয়তা ও বাড়তে পারে।

কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি

বিশ্বপল্লীর কূটনীতিকবিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন—যে কোনো বহিঃশক্তির নেতৃত্বে গাজায় দীর্ঘস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হলে সেখানে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া উদ্রেক হতে পারে। তাছাড়া, আরেকটি প্রকাশ্য উদ্বেগ হলো—যদি তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব সীমিত থাকে, তবে সেটি চাপ, অসন্তোষ ও বিস্ফোরক পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করবে। অপরদিকে, যদি প্রস্তাবনার মানবিক অংশগুলো বাস্তবায়িত হয়— বন্দিমুক্তি, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও আশ্রয় প্রদানে দ্রুত সহায়তা—তবে তা স্বল্পকালীনভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।

প্রশ্ন যা থেকে যাচ্ছে

সবশেষে যে প্রশ্নটি গুরুভার বহন করছে—এই ২০ দফা কি সত্যিকারের স্থায়ী শান্তির পথ খুলে দেবে, নাকি তা হবে গাজাকে কৌশলগতভাবে একটি নতুন নিয়ন্ত্রিত জোনে পরিণত করার কৌশল? নীলনকশার মধ্যে যারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ দেখেন, তারা এটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ হিসেবে দেখেন। আর যারা জাতিসংঘ মানদণ্ডে স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে গুরুত্ব দেন, তারা বলেন—গাজার ভবিষ্যৎ নির্ণয় হলে তা হবে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে, অন্যথায় কোনো বহিরাগত ‘শান্তি প্রকল্প’ কেবল ক্ষণস্থায়ী শান্তি দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *