অনলাইন ডেস্ক
দুনিয়া মানুষের জীবনের শেষ গন্তব্য নয়। ক্ষণস্থায়ী জীবনের পর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আখিরাতের বাস্তবতা। সেদিন প্রতিটি মানুষ আল্লাহর দরবারে একাকী হাজির হবে, যেখানে ধন-সম্পদ, সন্তান বা বন্ধু কেউই আর কাজে আসবে না। সেখানে মুখবন্ধ হবে জিহ্বা, কথা বলবে হাত-পা, সাক্ষ্য দেবে দুনিয়ার আমল।
আজ আমরা যে পাপ-গোনাহকে তুচ্ছ ভাবি, সেদিন তা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। আর তখন কেউ বলতে পারবে না— “আমি জানতাম না।”
এই ভয়াবহ দিনের প্রস্তুতির জন্যই মহানবী (সা.) তাঁর উম্মতকে বারবার সতর্ক করেছেন। এমন এক হাদিসে তিনি কিয়ামতের দিনের কঠিন হিসাব ও মুক্তির এক সহজতম উপায় তুলে ধরেছেন—যা একদিকে মানুষকে আল্লাহভীতিতে কাঁপিয়ে দেয়, অন্যদিকে আশার প্রদীপও জ্বালিয়ে দেয়।
সেই হাদিসটি হলো—
عَنْ عَدِيِّ بْنِ حَاتِمٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلاَّ سَيُكَلِّمُهُ رَبُّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ تُرْجُمَانٌ فَيَنْظُرُ أَيْمَنَ مِنْهُ فَلاَ يَرَى إِلاَّ مَا قَدَّمَ مِنْ عَمَلِهِ وَيَنْظُرُ أَشْأَمَ مِنْهُ فَلاَ يَرَى إِلاَّ مَا قَدَّمَ وَيَنْظُرُ بَيْنَ يَدَيْهِ فَلاَ يَرَى إِلاَّ النَّارَ تِلْقَاءَ وَجْهِهِ فَاتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ قَالَ الأَعْمَشُ وَحَدَّثَنِي عَمْرُو بْنُ مُرَّةَ عَنْ خَيْثَمَةَ مِثْلَهُ وَزَادَ فِيهِ وَلَوْ بِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ.
আদী ইবনু হাতিম (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তার রব অতি সত্বর কথা বলবেন। তার ও আল্লাহর মাঝখানে কোনো তর্জমাকারী থাকবে না। এরপর সে তাকাবে ডান দিকে, তখন তার আগের আমল ব্যতীত সে আর কিছু দেখবে না।
আবার তাকাবে বাম দিকে, তখনো আগের আমল ব্যতীত আর কিছু সে দেখবে না। আর সামনে তাকাবে তখন সে জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না। কাজেই জাহান্নামকে ভয় কর এক টুকরো খেজুরের বিনিময়ে হলেও। (বুখারি, হাদিস : ৭৫১২)
হাদিসের ব্যাখ্যা
হাদিসটির প্রথম অংশ: “তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তার রব কথা বলবেন, তার ও আল্লাহর মাঝখানে কোনো তর্জমাকারী থাকবে না।” এ বাক্যে কিয়ামতের দিনের এক মহা বাস্তব দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে।
সেদিন প্রতিটি মানুষ আল্লাহর সামনে একা উপস্থিত হবে।
কোনো দোভাষী থাকবে না, কোনো উকিল থাকবে না, কোনো বন্ধুও পাশে থাকবে না। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْدًا
‘কিয়ামতের দিনে সবাই একাকীভাবে তাঁর কাছে উপস্থিত হবে।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৯৫) অর্থাৎ, আল্লাহ প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন—তিনি কী করেছেন, কী বলেননি, কী নিয়তে কাজ করেছেন—সবকিছুই প্রকাশিত হবে।
এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন: কিয়ামতের দিন মানুষ নিজেকেই নিজের পক্ষে সাক্ষী হতে হবে। কোনো মধ্যস্থতাকারী বা অনুবাদক থাকবে না। মানুষের অন্তরের ভাবনা, কাজের উদ্দেশ্য, প্রতিটি শব্দ—সবকিছুই আল্লাহর সামনে প্রকাশ পাবে।
হাদিসের দ্বিতীয় অংশ: “এরপর সে তাকাবে ডান দিকে, তখন তার আগের আমল ব্যতীত আর কিছু দেখবে না; আবার তাকাবে বাম দিকে, তখনও তার আমল ব্যতীত আর কিছু দেখবে না।” এখানে কিয়ামতের দিনের হিসাবের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ যখন তার ডান দিকে তাকাবে—সেখানে তার সৎ আমলগুলো (নামাজ, দান, সিয়াম, সৎকর্ম, সাহায্য, ধৈর্য) দেখতে পাবে। বাম দিকে তাকালে দেখবে তার অপকর্মগুলো (পাপ, মিথ্যা, অহংকার, প্রতারণা, অন্যায়ের আচরণ)। এটি নির্দেশ করে যে, কিয়ামতের দিন কেউ কারও পক্ষে কোনো আমল বহন করবে না, বরং প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ আমলের ফল ভোগ করবে। মহান আল্লাহ বলেন-
فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَهٗ ؕ﴿۷﴾ وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَهٗ ﴿۸﴾
‘যে ব্যক্তি পরমাণু পরিমাণ সৎকর্ম করবে, সে তা দেখতে পাবে, এবং যে পরমাণু পরিমাণ অসৎকর্ম করবে, সেও তা দেখতে পাবে।’ (সুরা যিলযাল, আয়াত:৭–৮) অর্থাৎ, আমাদের প্রতিটি ক্ষুদ্র কর্ম—ভালো বা খারাপ—সবই সেখানে চিত্রিত অবস্থায় আমাদের সামনে উপস্থিত থাকবে।
হাদিসের তৃতীয় অংশ: “আর সামনে তাকাবে, তখন সে জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না।” এই বাক্যে কিয়ামতের মাঠের এক ভয়াবহ দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। যখন মানুষ বুঝতে পারবে—তার পেছনে আমলের রেকর্ড, ডানে-বামে কর্মফল, আর সামনে অপেক্ষা করছে জাহান্নাম—তখন তার অন্তর ভয়ে কেঁপে উঠবে।
এই বাক্যটি মানুষকে গভীরভাবে সতর্ক করছে যে, জাহান্নাম এমন বাস্তব বিপদ যা থেকে মুক্তি পেতে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সেদিন কোনো দুঃখ প্রকাশ, অনুতাপ বা আবেদন কাজে আসবে না।
হাদিসের চতুর্থ অংশ: “কাজেই জাহান্নামকে ভয় কর এক টুকরো খেজুরের বিনিময়ে হলেও।” এই বাক্যটিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহান্নামের ভয়ের পর আশার আলো দেখিয়ে মানুষকে দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তা যত ছোটই হোক। কারণ কোনো সৎকর্মই তুচ্ছ নয়। খেজুরের এক টুকরোও যদি কারো ক্ষুধা মেটায়, তবে সেটিও জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণ হতে পারে সহিহ মুসলিমের এক হাদিসে এসেছে- ‘একটি খেজুরের অর্ধেক দান করেও জাহান্নাম থেকে বাঁচো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০১৬)
এখানে “অর্ধেক খেজুর” প্রতীকী অর্থে এসেছে— যে যতটুকু সামর্থ্য রাখে, সেই অনুযায়ী দান করবে।আল্লাহ তাআলা দানকারীর নিয়ত ও আন্তরিকতার কদর করেন, পরিমাণের নয়।
অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন সাহাবিদের বলেছিলেন—‘তোমরা এক টুকরা খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ। আর যদি কেউ সেটাও না পাও তাহলে উত্তম কথার দ্বারা হলেও (আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কর)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫৪০)
অর্থাৎ, জাহান্নাম থেকে বাঁচার পথ একটাই— ছোট-বড় সকল সৎকাজে অংশ নেওয়া, অন্তরকে বিশুদ্ধ রাখা এবং আল্লাহর সামনে উপস্থিতির জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা।
















Leave a Reply